ভৈরব যুদ্ধ, কিশোরগঞ্জ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ করলে বাংলাদেশে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিভিন্ন ইউনিটগুলি প্রতিরোধযুদ্ধে লিপ্ত হয়। সিলেটের শমসের নগরে অবস্থানরত মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে বিদ্রোহী ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় সকল ইউনিট ২৭ মার্চ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান গ্রহণ করে। এই বেঙ্গল রেজিমেন্ট সিলেট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। এদিকে ঢাকার জয়দেবপুরে অবস্থানরত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। এই বেঙ্গল ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ভৈরব হয়ে ৩১ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খালেদ মোশাররফের সঙ্গে মিলিত হয়। তখন এই দুই বেঙ্গল সম্মিলিতভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারা পাকবাহিনীর অগ্রাভিযানকে বাধা প্রদান ও একই সঙ্গে সিলেট ও কুমিল্লায় যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে সুস্থ পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালনা মুক্তিবাহিনীর জন্য ছিল দুঃসাহসী কাজ। ভৈরব যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানগুলো হলো- ১. আশুগঞ্জে ক্যাপ্টেন নাসিম এর নেতৃত্বে এক কোম্পানী নিয়মিত সৈন্য মোতায়েন করা হয়। ২. আশুগঞ্জের ৩ মাইল উত্তরে আজবপুর নামক স্থানে একজন জেমিও’র অধীনে মোতায়েন করা হয় এক কোম্পানী নিয়মিত সৈন্য। ৩. আশুগঞ্জ থেকে ২ মাইল দক্ষিণে লালপুরে লেঃ হেলাল মোরশেদের নেতৃত্বে নিয়মিত এবং অনিয়মিত সৈনিকদের সংমিশ্রণে গঠিত একটি কোম্পানিকে মোতায়েন করা হয়। এই কোম্পানির দায়িত্ব ছিল ঐ এলাকায় নৌপথে যাতে কোনো শত্রুসৈন্য অবতরণ করতে না পারে তার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ। ৪. ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন একটি মিশ্র কোম্পানিকে নিয়ে তিতাস নদীর পাড়ে গোকর্ণঘাট এলাকা রক্ষার দায়িত্বে থাকেন। ৫. ক্যাপ্টেন মতিন এক কোম্পানী ইপিআর নিয়ে সরাইলে অবস্থান গ্রহণ করেন। এই কোম্পানীকে রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে গণ্য করা হয়। ৬. ভৈরবের ২ মাইল উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত রামনগর রেলসেতুতে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে ক্যাপ্টেন মতিউরের নেতৃত্বে এক কোম্পানী ইপিআর সদস্য। ১৩ এপ্রিল তেলিয়া ভেলিয়াপাড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় আগত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দলটিকে তার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাদের অবস্থান ছিল ভৈরব আশুগঞ্জ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংযুক্ত এলাকায়। ২য় ইস্ট বেঙ্গলের এক দল সৈন্য ক্যাপ্টেন মতিউর এর নেতৃত্বে পাঁচদোনা ও নরসিংদীতে অগ্রাভিযানের পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিরোধ করে। পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রবল শক্তি প্রয়োগ করে। ক্যাপ্টেন মতিউর পাকবাহিনীকে ক্রমান্বয়ে বাধা দিতে দিতে ভৈরবের দিকে পিছিয়ে আসতে থাকেন। পাকবাহিনীও তাদের অনুসরণ করে সম্মুখে অগ্রসর হয়। কিন্তু পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ভৈরবের কিছু আগে অবস্থিত পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের উপর রামনগর রেল সেতুটি নষ্ট করে ফেলা হয়। ক্যাপ্টেন মতিউর তার বাহিনী নিয়ে রামনগরে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৪ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তানী নৌবাহিনীর একটি বহর আশুগঞ্জের দুই মাইল দক্ষিণে লালপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে অবস্থান গ্রহণ করে এই সৈন্যবহর অবতরণের জন্য উপযুক্ত স্থান পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এমনি অবস্থায় এই স্থানে পূর্ব থেকে অবস্থানরত লেঃ হেলাল মোরশেদের বাহিনীর দ্বারা এই নৌবহরটি লালপুরে আক্রান্ত হয়। প্রায় এক ঘন্টা উভয়ের মধ্যে গোলাগুলি চলে এবং নৌবহরটি অবস্থান পরিবর্তন করে দক্ষিণ দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়। এদিকে লালপুর আক্রান্ত হওয়ার আশংকায় সরাইলে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানী লালপুরে চলে আসে। ১৫ এপ্রিল ভোর সাড়ে পাঁচটায় ভৈরব, লালপুর ও আশুগঞ্জের মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে শুরু হয় পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণ। খানাবাড়ি রেল স্টেশনে অবস্থানরত পাকবাহিনীর আর্টিলারী ব্যাটালিয়ন এই গোলাবর্ষণ চালায়। এটা ছিল প্রি এইচ আওয়ার গোলাবর্ষণ। এই গোলাবর্ষণের সুযোগে পাকবাহিনীর নৌবহরটি আবারও লালপুরে এসে উপস্থিত হয়। এরা মূলত গোলাবর্ষণের ছত্রছায়ায় লালপুরে অবতরণের জন্য আসছিল। নৌবহরে ছিল দু’টি গানবোট, দু’টি ল্যান্ডিং ক্রাফট ও চারটি লঞ্চ। একই সময়ে রেল পথ ধরে পাকবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন ভৈরবের দিকে অগ্রসর হয়। ইতিপূর্বে মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে শত্রুদের প্রতিহত করে তাদের অগ্রগতি বিলম্বিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে শেষ পর্যায়ে তাকে আশুগঞ্জে পিছিয়ে আসার পরামর্শ দেয়া হয়। এদিকে লালপুরে নৌবহরটি যখন আরও এগিয়ে আসে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নির্ণয়ের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় তখন মুক্তি বাহিনীর একজন সৈনিক উত্তেজনাবশতঃ গুলি করে বসে। এই অবস্থায় পাকিস্তানী সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গে ট্যাংক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে গোলাবর্ষণ শুরু করে। জবাবে মুক্তিবাহিনীও রকেট ল্যাঞ্চার ও মর্টার দিয়ে তাদের উপর গোলাবর্ষণের পাল্টা জবাব দেয়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের এই প্রচণ্ডতায় পাক নৌবহর তীর থেকে অন্যত্র ভেসে যাওয়া শুরু করে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানী বিমান বাহিনী যুদ্ধে যোগদান করে। ছয়টি স্যাবর জেট ভৈরব, আশুগঞ্জে, লালপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর বোমাবর্ষণ শুরু করে। বিমান আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করার মতো কোনো অস্ত্র তখন মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিল না। বিমান আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর একনাগাড়ে ৬ ঘন্টা বিমান আক্রমণ চলে। ১৫ এপ্রিল ভোরে এক ঝাঁক এসআই হেলিকপ্টার আশুগঞ্জ ও আজবপুরের মাঝামাঝি সোহাগপুরে পাকিস্তানী ছত্রীসেনা নামাতে শুরু করে। হেলিকপ্টার অবতরণে বাঁধা দেওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন নাসিম বিমান আক্রমণ উপেক্ষা করে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমজি পোস্টের কমান্ডার আবদুল হাই রেলপথের উপর স্থাপিত উন্মুক্ত পরিখা থেকে শত্রুদের উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু শত্রুর ৮৩ মিঃ মিঃ আর্টিলারি গান থেকে নিক্ষিপ্ত গোলা সরাসরি আবদুল হাইকে আঘাত করলে ঘটনাস্থলে তিনি শাহাদাতবরণ করেন। একটি পর্যায়ে শত্রুরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ঘিরে ফেলে। এখানে উভয় পক্ষের মধ্যে এক ঘন্টা হাতাহাতি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ক্যাপ্টেন নাসিম ও লেঃ হেলাল মোর্শদ আহত হলে যুদ্ধক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। অবস্থা বুঝে অধিনায়ক মেজর শফিউল্লাহ সৈন্যদের নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যায় আঁধারের আড়ালে ক্যাপ্টেন নাসিম সরাইলের দিকে সরে আসতে সক্ষম হয়। শফিউল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী পুরো বাহিনী নিরাপদ স্থানে সরে যায়। অপরদিকে পাক নৌবহরটি তিতাসের মুখে সৈন্য নামিয়ে দেয়। দ্বিমুখী আক্রমণের মুখে অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয় দেখে ক্যাপ্টেন মতিন সন্ধ্যায় রেলপথ বরাবর হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছেন। সেখান থেকে তিনি তার বাহিনী সরাইলে স্থানান্তর করেন। অবশেষে সৈন্যরা ৮ মাইল পথ হেঁটে শাহাবাজপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণের মুখে ক্যাপ্টেন মতিউরের পক্ষে নদীর পশ্চিমে অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে পড়ায় এবং মেঘনা সেতু ও নদী পারাপারের পথ অপর তীর পাকবাহিনীর করায়ত্ব হওয়ায় মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে উত্তর দিকে ভৈরব ও ময়মনসিংহ রেলপথ ধরে ক্যাপ্টেন মতিন তার বাহিনীসহ কুলিয়ার চরে পৌছান। পরে চাতালপাড় হয়ে তিনি মূল বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হন।
[১৬] এ এস এম সামছুল আরেফিন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত