You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভোলাহাট ও গোমস্তাপুর যুদ্ধ, চাঁপাই নবাবগঞ্জ

১৯ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহর পুনঃদখল করার পর তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে, থানা ও মফঃস্বল এলাকা গুলি দখলে আনতে দ্রুত বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তারা ২১ এপ্রিল গোমস্তাপুর থানা ও তার বৃহৎ এলাকা রহনপুর দখল করে নেয়। দখল অভিযান চালানোর সময় পাক হানাদার বাহিনী ব্যাপক জ্বালাও- পোড়াও, লুন্ঠন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকবাহিনী সমগ্র গোমস্তাপুর থানা এলাকা দখল করে তাদের সহযোগী শক্তি হিসেবে এদেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে পিসকমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলসামশ ও সিএফ বাহিনী গঠন করে। সংগঠিত দালালদের সহায়তায় দখলদার বাহিনী রহনপুর- গোমস্তাপুরে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ১১ জুলাই ভোলাহাট থানা এলাকা দখল করার উদ্দেশ্যে অভিযান চালায়। কিন্তু পাকবাহিনী ভোলাহাট ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা বাংলার বীর সন্তানদের কাছে পঞ্চনন্দপুর গ্রামের পশ্চিমে কঠোর প্রতিরোধের মুখে বাধা প্রাপ্ত হয়। এরপর শুরু হয় মরণপণ মুক্তি সংগ্রাম। ভোলাহাট থানা ভবন হেডকোয়ার্টার থেকে মুক্তিবাহিনীর টহল দলের সাথে পঞ্চনন্দপুর, মুশরীভূজা এলাকায় কয়েক দফা হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। ওই সব যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী সফল হয়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা ঘাইবাড়ী, কাশিয়াবাড়ী এলাকায় দু’দফা সফল অপারেশন পরিচালনা করেন এবং আলমপুর পর্যন্ত মুক্তি বাহিনীর টহল তৎপরতা অব্যাহত থাকে। ২ আগস্ট মুশরীভূজা যুদ্ধের পর থেকে মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন সময় অবস্থার প্রেক্ষাপটে ঘাইবাড়ী ঈদগাহ ময়দান ও ওয়াপদা ক্যানেল, দলদলী, আলমপুর, কাশিয়াবাড়ী ও কালুপুরে ডিফেন্স স্থাপন করে। কিন্তু পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্র ও প্রচন্ড চাপের মুখে বেশ ক’বার মুক্তিবাহিনীকে ডিফেন্স উইথড্র করে পিছু হটে আসতে হয়। ১০ আগস্ট মঙ্গলবার কালপুর যুদ্ধে দখলদার বাহিনীর অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্রের মুখে প্রচণ্ড চাপের ফলে মুক্তিবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে রাতে থানা ভবনে ফিরে আসে এবং পর মুহূর্তে জজ আঃ হান্নান চৌধুরী ও হাফিজুর রহমান হাসনুর নির্দেশে ক্যাপ্টেন আলতাফের নেতৃত্বে ৬০/৭০ জন মুক্তিবাহিনীর সদস্য দলদলী গমন করেন। দলদলীতে সেরাজ বিশ্বাসের (রশিক শাহ মহাজনের পরিত্যাক্ত বাড়ী) ফাঁকা বাড়িতে মুক্তিবাহিনী স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। এই ক্যাম্প মুক্তিবাহিনীর ‘দলদলী কম্পানি হেডকোয়ার্টার’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই কম্পানি হেডকোয়ার্টার থেকে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ যুদ্ধ এগিয়ে চললো। মুক্তিযোদ্ধারা ভোলাহাট অঞ্চল মুক্ত রেখে গোমস্তাপুর থানার বৃহত্তর এলাকা রহনপুর থেকে হানাদার বাহিনীকে বিতাড়ন ও এলাকা পুনরুদ্ধার করতে কঠোর মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত হন। দলদলীতে কম্পানি হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে ক্যাপ্টেন আলতাফ এর কমান্ডার হিসেবে (কম্পানি কমান্ডার) দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে লেঃ রফিকুল ইসলাম ও মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম প্রায় শ’খানেক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে দলদলী কম্পানি হেডকোয়ার্টারে যোগদান করেন। এখানে যোগদান করে লেঃ রফিক কম্পানি হেডকোয়ার্টার কমান্ডার (কম্পানি কমান্ডার) এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দলদলী কম্পানি হেডকোয়ার্টার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে টহল তৎপরতা জোরদার করা হয়। একটি বৃহৎ দল নদীর ওপারে তেলীপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। এখানে নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আলতাফ হোসেন এবং বিভিন্ন ডিফেন্স ও যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন ইপিআর কাদের। ইপিআর ইসমাইল (বগুড়া), ইপিআর জেসিও কফিল উদ্দিন ও ইসলামের রায়হান (সিলেট)। মুক্তিযোদ্ধারা সন্দেশপুর, আলীনগর, ইমামনগর ঘুন্টি ও রেলাইন এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ডিফেন্স স্থাপন করেন। এই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর প্রবল আক্রমণ কঠোর অবস্থার মধ্যে দিয়ে মোকাবিলা করেন। নদীর এপারে কাশিয়াবাড়ী, কালুপুর ও পরবর্তীতে সাহাপুর গড়ে মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্স দেয়া হয়। এই সব ডিফেন্সে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপের নেতৃত্ব দেন ইপিআরের নায়েক ওয়াশিল মোল্লা, ইপিআরের ল্যান্স নায়েক মনির, সুবাদার গফুর, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বুদ্ধ, জয়নাল আবেদীন, আকতার আলী খান কচি, নজরুল ইসলাম, আঃ রাজ্জাক রাজা, চুটু মাষ্টার, ইপিআর হাবিলদার গিয়াসউদ্দিন, সুবাদার মীর মোকাদ্দেশ, সুবাদার কুতুবউদ্দিন, সানাউল্লাহ- প্রভৃতি। দলদলী কম্পানি কমান্ডার হিসেবে লেঃ রফিক সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। ৩নং মোহদীপুর সাব-সেক্টরের আওতাধীন এই অঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিল ও দুঃসাহসী অপারেশন ও যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার মেজর নামজুল হক (মরহুম), পরবর্তী সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, লেঃ বজলুর রশিদ, লেঃ কাইয়ুম খান, ক্যাপ্টেন ইদ্রিশ- প্রভৃতি সেনা অফিসার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এছাড়া নাম জানা/অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ সংগ্রাম, আত্মাহুতি ও তাঁদের বুকের তাজা রক্ত রঞ্জিত হয়ে এই অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়।
ভোলাহাট থানা ভবন হেডকোয়ার্টার থেকে বাংলার দামাল ছেলেরা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে ভোলাহাট এলাকাকে শত্রুমুক্ত রাখতে সমর্থ হন। এরপর তাঁরা দলদলীতে স্থায়ী ক্যাম্প (কম্পানি কমান্ড) স্থাপন করেন। দলদলী কম্পানি কমান্ড থেকে গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া, বাঙ্গাবাড়ী, আলীনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিবাহিনী ডিফেন্স স্থাপন করে পাক দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কালুপুর, সাহাপুর গড়, বোয়ালিয়া, ইমামনগর ঘুন্টি, শ্যামপুর যুদ্ধ এবং ভোলাহাট উপজেলার পঞ্চনন্দপুর, মুশরীভূজা ও বড় জামবাড়ীয়া যুদ্ধ ইতিহাসে বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বহুত্যাগ তিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে পাকবাহিনীর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, ধর্ষণ, হত্যা প্রতিহত করে মুক্তিবাহিনী ১৪ ডিসেম্বর সমগ্র গোমস্তাপুর উপজেলা শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হয়। উল্লেখ, মুক্তিবাহিনীর কাছে দখলদার বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে তাদের পরিধি সঙ্কুচিত হয়ে আসার দরুন তারা ১৩ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে ট্রেনযোগে রহনপুর-গোমস্তাপুর ছেড়ে পলায়ন করে। মুক্তিবাহিনী সামনে নাচোল, চাঁপাই নববাগঞ্জ ও রাজশাহী অভিমুখে অগ্রসর হয়।
[৫৭৪] মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!