You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাতশালা যুদ্ধ, সাতক্ষীরা - সংগ্রামের নোটবুক

ভাতশালা যুদ্ধ, সাতক্ষীরা

ভাতশালা সাতক্ষীরার দেবহাটা থানার একটি গ্রাম, ইছামতি নদীর তীরে অবস্থিত। এপারে বাংলাদেশ, ওপারে ভারত। দু’দেশের সীমানা নির্দেশ করে আপন গতিতে বয়ে চলে ইছামতি। মুক্তিযুদ্ধের এক নীরব দর্শক এই ইছামতি। লাখ লাখ শরণার্থীর দুঃখ বেদনার সাক্ষী এই ইছামতি নদী। অনুরূপভাবে ভাতশালার স্মরণীয় যুদ্ধের নীরব সাক্ষীও এই ইছামতি।
শাঁখরা কোমরপুরে একটা বিওপি বা বর্ডার অবজারভেশন পোষ্ট বা পর্যবেক্ষণ পোষ্ট, ইপিআররা মূলত এখানে থাকত। পরবর্তীকালে কমান্ডার খিজিরের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা শাঁখরা বিওপি আক্রমণ করে তা দখল করে নেয় এবং অস্ত্রশস্ত্র পায় প্রচুর। তাছাড়া কমান্ডার খিজির আলী খানজিয়া, শ্রীপুর, বসন্তপুরসহ কয়েকটি বিওপিতে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে সেসব বিওপি দখল করে নেন, এসব যুদ্ধে তাঁর বিশ্বস্ত ত্রিশ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেয়।
এসব সমস্যা নিরাসনে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার শাঁখরা কোমরপুর পাকসেনা ঘাঁটিতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। খানসেনাদের এ ঘাঁটি আক্রমণে মূল সমস্যা ছিল, নদী ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে পিছনে হটার কোন স্থান ছিল না। কিন্তু এ সময় উত্তর দিকটা মোটামুটি মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। গেরিলাযুদ্ধ বা সামরিক নীতিমালায় এ আক্রমণ করা ছিল অবাস্তব একটি অভিযান।
ভাদ্র মাস। বৃষ্টিপাত প্রচুর। ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার তাঁর বাহিনীকে মোটামুটি ৩টা ভাগে ভাগ করেন। প্রথম ভাগের দায়িত্বে তিনি নিজেই, যে দলটি থাকবে ইছামতি নদীর পাড়ে ওয়াপদা রাস্তার নিচে। তার সাথে অন্যান্যদের মধ্যে আবদুর রহীম, গোপী, আবদুল, গণি, মোফাজ্জল, আবদুল গাফফার গোলজার, ইয়াসিন, জামশেদ প্রমুখ।
দ্বিতীয় দলে ছিলেন লেঃ মুখার্জীর কতিপয় অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, বরিশাল নবম সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত থাকায় বরিশাল জেলার মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত এলাকায় অনেক যুদ্ধে অংশ নেন এবং বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেন। ভাত শালার যুদ্ধেও বরিশাল জেলার মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
তৃতীয় দলে ছিলেন লে. মুখার্জীর নেতৃত্বে একদল বীর যোদ্ধা। তারা উত্তর প্রান্ত থেকে ফায়ার দেবে এবং ঐ এলাকা তাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখবে। দুটো দু ইঞ্চি মর্টার, কয়েকটা এলএমজি এসএলআর, গ্রেনেড এবং প্রচুর গোলাবারুদসহ মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পনা মোতাবেক যথাসময়ে তাদের স্ব স্ব অবস্থানে যায়। তারপর বর্ষণমুখর এক সন্ধ্যায় শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। শাঁখরাও কোমরপুর বিওপি থাকায় এটা ছিল খাসসেনাদের একটা শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ, পিছনে তাদের সরবরাহ লাইন ছিল খোলা এবং নিরাপদ। পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর পিছন দিকে ভারত সীমান্ত নদী ইছামতি। সুতরাং সরবরাহ বা যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন ; কেবলমাত্র উত্তর দিকে কিছুটা মুক্ত অঞ্চল ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ভরসা। ভাতশালা, শাঁখরা-কোমরপুর পাশাপাশি গ্রাম, মূল যুদ্ধ হয় ভাতশালা গ্রামে, তাই এ যুদ্ধকে ভাতশালা যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়।
অবিরাম বৃষ্টির ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ, রসদ ভিজে যায়। খাওয়া- দাওয়া ও বিশ্রামের তেমন কোনই ব্যবস্থা ছিল না। তবুও জীবনপণ করে তারা যুদ্ধ করে, অবিরাম বৃষ্টি পরোক্ষভাবে মুক্তিবাহিনীর জন্য দারুণ সহায়ক হয়। কারণ সাতক্ষীরা থেকে নতুন করে পাকবাহিনী এসে এদের সাথে অতি বৃষ্টির ফলে যোগ দিতে পারেনি। বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে পাকসেনারা গোলাগুলি করতে থাকে এবং মুক্তিবাহিনীও বীরদর্পে একটানা জবাব দিতে থাকে। দু’ রাত, একদিন প্রচণ্ড যুদ্ধ চলে। খানসেনেরা অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার পরও তারা কোন মতে সামনে অগ্রসর হওয়ার কোন সুযোগ পায়নি। ক্যাপ্টেন শাজাহান মাস্টারের দক্ষ পরিচালনায় সকল অসুবিধা মোকাবিলা করে মুক্তিবাহিনী লড়তে থাকে। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে কতক্ষণ যুদ্ধ করা যায়?
যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকসেনাদের ১০/১২ জনের একদল দুর্ধর্ষ সৈনিক হামাগুড়ি দিতে দিতে মুক্তিবাহিনীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন মুক্তিবাহিনী তাদের প্রতি একযোগে ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে। ফলে খানসেনাদের ৫/৬ জন গুলি খেয়ে সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এবং কয়েকজন আহত হয়।
কিন্তু বীর বেশে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় খানসেনাদের একটা গুলি এসে গোলজারকে মারাত্মকভাবে আহত করে। অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়, ভাতশালার এ যুদ্ধে গোলজার শহীদ হয়। অতঃপর এ যুদ্ধের অধিনায়ক অন্যান্যদের সাথে পরামর্শ করে যুদ্ধ প্রত্যাহার করে মুজিবনগরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ ফলে একে একে প্রত্যাহার শুরু হয়। সর্বশেষ দলে ক্যাপ্টেন শাজাহান মাস্টারও প্রত্যাবর্তন করেন।
ভাতশালা যুদ্ধের গতি প্রকৃতি ছিল বিচিত্র। মুক্তিযোদ্ধারা বার বার ওদের ঘাঁটি দখল করার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ প্রচেষ্টা নেয় কিন্তু সফল হয়নি। আবার এত অনুকূল অবস্থায় থেকেও পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে যুদ্ধের জয় পরাজয়ের কোনটাই নির্ধারিত হয়নি সত্য। তবে পাকসৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিকতা দেখে নিঃসন্দেহে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল।
ভোরের আগেই মুক্তিবাহিনীর সবাই যে যেদিকে পারে চরম হতাশায় অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়ায়। কেউ চলে যায় হাজী ওয়াজেদ আলী জোয়াদ্দারের বাড়ি। কেউ যায় সোহরাব হাজীর বাড়ি। কেউ যায় গাবুরা গ্রামের নওশের আলী গাইনের বাড়ি। কেউ যায় কপোতাক্ষ পার হয়ে তৎকালীন পাইকগাছা থানার ঘুছিলাল গ্রামের জনাব আলী খানের বাড়ি। এই এলাকা তখন ইয়াহিয়া খান, মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের দালালে ভর্তি। তাদের কাছে পাকিস্তান নাকি পবিত্র আমানত, তাই এদেরকে ধরিয়ে দেয়ার চিন্তায় ছিল। অনেকেই আবার স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। সোহরাব হাজীর একটি ছেলে মেজর জলিল ও তার সঙ্গীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন, টাকা পয়সা দেন, এমনকি পথ দেখিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেন। আজিজ তরফদার ও এলাহী বক্স মোড়ল মাইনুর ইসলাম ও একজন মেডিকেল ছাত্রকে ভালভাবে সেবা যত্ন ও খাওয়া দাওয়া করিয়ে পথ খরচ দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেন।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত