ভুয়াপুর সেক্টর থেকে মুক্তিযোদ্ধা অপসারণ, টাঙ্গাইল
ভুয়াপুর থানাটি টাঙ্গাইল সদর থেকে উত্তরে এবং যমুনা নদীর পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। কাদেরীয়া বাহিনীর অন্যতম দুর্জয় ঘাঁটি ছিল ভুয়াপুর থানা। টাঙ্গাইল-মধুপুর সড়কের পশ্চিম দিক থেকে যমুনা-ধলেশ্বরীর পাড় পর্যন্ত উত্তরে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে দক্ষিণে বিস্তীর্ণ নাগরপুর চর অঞ্চল নিয়ে পশ্চিম সেক্টর গড়ে উঠে ছিল। আর এই সেক্টরের সদর দপ্তর ভুয়াপুর। এই ভুয়াপুর সেক্টরের উপর টাঙ্গাইলে মুক্তিযুদ্ধের অতি গুরুদায়িত্ব এসে পড়ে।
৭ জুলাই পাকিস্তানিরা কাদেরীয়া বাহিনীর সদর দপ্তর সহ পূর্বাঞ্চলীয় মুক্ত এলাকায় তীব্রতর আক্রমণ পরিচালনা করে। এমতাবস্থায় অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী ভুয়াপুর পশ্চিম দিক থেকে শত্রুর ওপর আক্রমণ শুরু করার জন্য কমান্ডারদের দায়িত্ব দেন। এমনভাবে হামলা চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয় যাতে শত্রু সার্বক্ষণিক ব্যতিব্যস্ত থাকে। কাদের সিদ্দিকী আরও নির্দেশ দেন যে, গোপালপুর থানা বর্তমান অবস্থায় রণকৌশলের দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় ; কাজেই এই থানা এলাকায় ঘাঁটি রক্ষার জন্য অনর্থক গোলাবারুদ নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। বরং গোপালপুর ছেড়ে দিয়ে আশেপাশের গ্রামের মধ্যে সরে গিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করাই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মঙ্গলজনক। অবশ্য ভারতের সাথে নদী পথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য এই ঘাঁটির গুরুত্ব অপরিসীম।
অধিনায়কের নতুন নির্দেশ অনুসারে কাজ করার জন্য পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে এ জন্য ২৬ জুলাই কোম্পানি কমান্ডারদের এক জরুরি সভা ডাকা হয়। কোম্পানি কমান্ডার হাবিবুর রহমান, আবদুল গফুর, খোরশেদ আলম, রেজাউল করিম তরফদার, হুমায়ুন, বেনু, আমানউল্লাহ, ইন্টিলিজেন্স প্রধান নুরুন্নবী, বেসামরিক প্রশাসক মোয়াজ্জেম হোসেন খান দীর্ঘ আলোচনায় বসেন৷ অধিনায়কের নির্দেশ অনুযায়ী আক্রমণ পরিচালনার জন্য স্থির হয়— হাবিবুর রহমান তার কোম্পানির বাছাই করা যোদ্ধাদের নিয়ে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের ওপর তাদের হামলা সীমিত রাখবে। এই সড়কের উপর দিয়ে যাতায়াতকারী দুশমনের সকল যানবাহন হবে তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। হুমায়ুন তার কোম্পানি নিয়ে গোপালপুর থানা এলাকায় অবস্থান করবে এবং শত্রুর উপর নিরন্তর আক্রমণ চালাবে। খোরশেদ আলম তার কোম্পানি নিয়ে এলেঙ্গার কাছে অবস্থান নিয়ে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। আমানউল্লাহর উপর দেওয়া হয় অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব। সে তার কোম্পানি নিয়ে টাঙ্গাইল শহরের উত্তর দিক থেকে দুশমনের মূল ঘাটিতে আক্রমণ পরিচালনা করবে। কমান্ডার গফুর ভুয়াপুর সদর দপ্তরসহ নদী পথের পাহারায় থাকবে। নদীপথের রক্ষণভাগে এককভাবে খবরদারী করবে হাবিবুর রহমান ও রেজাউল করিমের কোম্পানি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর কমান্ডারগণ তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব পালনের জন্য তৎপর হয়।
অধিনায়ক হাবিব তার দলের ১৫ জন দুঃসাহসী যোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল মধুপুর সড়কের দিকে রওয়ানা হয়। তারা সড়কের ২ মাইল পশ্চিমে একিট গ্রামে আত্মগোপন করেন। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তাঁদের চারদিকে কড়াভাবে পাহারা দেয় এবং রাস্তায় দুশমনের চলাচলের উপর কড়া নজর রাখে।
ইছাপুর পুল ধ্বংস করার পর পাকিস্তানিরা ঢাকা-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের প্রত্যেকটি পুলের উপর কাড়া পাহারার বন্দোবস্ত করে। মোতায়েন করে অসংখ্য রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনী। কমান্ডার হাবিব ওদের এই ব্যবস্থাকে একটা বড় সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। ঐ রাতেই সে রাজাকারদের উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। তার দলের চতুর যোদ্ধা ফজলু ও স্থানীয় একজন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে রাজাকারদের অবস্থান জরিপ। তারপর রাত প্রায় বারটার সময় তার দলবল নিয়ে কালিদাসপাড়া অভিমুখে রওয়ানা হয়। হাবিব তার দলকে দু’ভাগে ভাগ করে। একদলে রইল হাবিব, ফজলু, কামরুল ও অপর কয়েকজন এবং অন্য দলে থাকল লুৎফর ও আরো কয়েকজন। হাবিব স্বয়ং রাজাকার ঘাটির খুব কাছাকাছি অবস্থান নেয়। এই ঘাটির খুব কাছে একটি বাড়ি। বাড়ির দিক থেকে হামলা চালালে শত্রুরা বাড়িটি পুড়িয়ে দিতে পারে, তাই বাড়িটির বিপরীত দিক থেকে আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রাজাকার ক্যাম্পের পশ্চিম- দক্ষিণ কোণ থেকে হাবিব আক্রমণ শুরু করে। আর লুৎফর সড়কের পূর্বদিক থেকে রাজাকার ক্যাম্পের দক্ষিণ পাশে ঠিক ওদের থাকার ঘরে আক্রমণ চালায়। গভীর রাতে এই দ্বি-মুখী আক্রমণের মুখে রাজাকাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে। ২০ মিনিট ধরে আক্রমণ ও ক্ষীণ পাল্টা আক্রমণের পর রাজাকাররা ১১টি মৃতদেহ পেছনে ফেলে পালিয়ে যায়। এই আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ১৪টি ৩০৩ রাইফেল ও ৭০০ রাউণ্ড গুলি উদ্ধার করে। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনোরূপ ক্ষতি হয়নি।
অন্যদিকে পাকিস্তানি অস্ত্রশস্ত্রবাহী জাহাজ ধ্বংস করার পর শত্রু ভুয়াপুরের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। সেই আক্রমণের মুখে সম্মুখ যুদ্ধে টিকে থাকা মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে অ্যামবুশের মাধ্যমে শত্রুসেনাদের ক্ষতি সাধনে সচেষ্ট হয়। ১৩ই আগস্ট ভূয়াপুর থানার সন্নিকটে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে শত্রুর টহল দলের বেশ কিছু সৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা আচমকা এ ধরনের অ্যামবুশের মাধ্যমে শত্রুকে তটস্থ রাখতো।
শত্রুর বিভিন্নমুখী আক্রমণ ভূয়াপুর রক্ষাব্যূহের কাছে বার বার প্রতিহত হয়েছে। ১৮ নভেম্বর পাক সেনাদলের ৫টি সশস্ত্র বোট ভূয়াপুরের নিকট মুক্তিবাহিনীর কর্তৃক আক্রান্ত হয় এবং গানবোটের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। উক্ত অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধা শফিউল্লাহ, আহাম্মদ আলী, আবদুল মুনছুর আলী, ইদ্রিস আলী ও লুৎফর রহমান অংশ গ্রহণ করেন।
[৫৯৫] ফিরোজ খায়রুদ্দিন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত