You dont have javascript enabled! Please enable it! ভুরুঙ্গামারী কলেজে অপারেশন, কুড়িগ্রাম - সংগ্রামের নোটবুক

ভুরুঙ্গামারী কলেজে অপারেশন, কুড়িগ্রাম

ভুরুঙ্গামারী থানা সদরে ভুরুঙ্গামারী কলেজ। একাত্তরের উথালপাথাল দিনে শিক্ষাদান কার্যক্রম স্থগিত। কলেজে পাকিস্তানী মিলিটারি ক্যাম্প। অবস্থান নিয়েছে তাদের বিরাট একটি দল। নেতৃত্ব দিচ্ছে একজন মেজর। চারপাশের গ্রামে গ্রামে চালিয়ে যাচ্ছে তারা হত্যা ও নারী নির্যাতনের মতো জঘন্য অপরাধকর্ম। তাদের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সাধারণ গ্রামবাসী। রেহাই পাচ্ছে না নারী-শিশু বৃদ্ধরাও। এ সময়ে সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর গ্রহণ করা হয় ভুরুঙ্গামারী কলেজ অপারেশন পরিকল্পনা। পরিকল্পনায় অংশগ্রহণকারী দলটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। দুটি অ্যাকশন গ্রুপ এবং একটি কভারিং গ্রুপ। দুই ইঞ্চি মর্টার এবং এল.এম.জিসহ প্রচুর অস্ত্র নিয়ে শুরু হয় যাত্রা। সে দিনটি ছিল সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো একদিন। মুক্তিবাহিনী সাহেবগঞ্জ সীমান্ত দিয়েই অতিক্রম করে। এগিয়ে যায় ভোটহাট দিয়ে। তারপর মানিক কাজী। আরো সামনে গিয়ে সোনাতলার পূর্ব পাশে অবস্থান নেয় কভারিং পার্টি। সেখানেই অবস্থান নেন সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন আহমদ। তিনি নিজেই পরিচালনা করছিলেন কভারিং পার্টি। অন্য গ্রুপগুলোর একটি সোনাতলা থেকে সরাসরি চলে আসে কলেজে। কলেজের দক্ষিণ পাশ দিয়ে ঘুরে পূর্ব পাশে অবস্থান নেয় তারা। দ্বিতীয় দলটি দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি কলেজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ঝটিকা আক্রমণ চালায়। কারো কারো মতে, অপারেশন পরিচালনায় যাত্রা করার আগে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ যে ব্রিফিং দিয়েছিলেন সে অনুযায়ী সবকিছু বাস্তবায়ন হয় নি। এর জন্য অনেকেই আবার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনকেই দায়ী করে থাকেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পরিকল্পনামাফিক প্রথম ব্যাচ কলেজে প্রবেশ করেই দু’বার ব্রাশফায়ার করার সাথে সাথে কভারিং পার্টি গোলাবর্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। এখানেও একটা ভিন্ন মতের উল্লেখ পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন, কভারিং পার্টি সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে রওনা হওয়ার আগেই অন্য দুটি গ্রুপ দুধকুমার নদী অতিক্রম করে পৌঁছে যায় গন্তব্যে। অ্যাকশনও শুরু করে তারা সাথে সাথে৷ প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরুর আগেই দু’জন মুক্তিযোদ্ধা ক্রলিং করে এগিয়ে যায় সামনে। কলেজের পূর্ব পাশে ছিল একটি পুকুর। এর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটি এইচ.এম.:জি, পোস্ট এবং উত্তর-পূর্ব কোণেও আরেকটি পোস্ট। দুটি এইচ.এম.জি. স্তব্ধ করার জন্য দু’জন দু’জন করে এগিয়ে যায়। বাঙ্কারের একেবারে কাছে গিয়ে গ্রেনেড ছুঁড়ে খতম করে দেয় পাকিস্তানী হায়েনাগুলোকে। স্তব্ধ হয়ে যায় এইচ. এম. জি। উড়ে গেল বাঙ্কার পর্যন্ত। তারপর এস. এম. জি থেকে ব্রাশফায়ার করে দক্ষিণ দিক থেকে বীর যোদ্ধারা প্রবেশ করে পুকুর পাড় দিয়ে এবং পরে কলেজের অভ্যন্তরে। বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ হচ্ছে। তখন পাকিস্তানী সেনেরা থমমত খেয়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মরতে থাকে খান সেনারা। বাকিরা দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পরাস্ত হয়ে যায়। কলেজের মাঠে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মৃতদেহগুলো। কলেজে পাকিস্তানী হায়েনাদের পরাজয়ের পর মুক্তিসেনারা উল্লসিত হলেও এরমধ্যেই উত্তরে বাজার এলাকা থেকে পাকিস্তানীরা প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ভারি অস্ত্রে গুলি করতে করতে অগ্রসর হতে থাকে তারা কলেজের দিকে। তখনো মুক্তিসেনারা কলেজের ভেতরে পাকিস্তানী হায়েনা খুঁজছিল। কিন্তু প্রচণ্ড হামলা প্রতিহত করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। তাই দক্ষিণ দিকে পূর্ব নির্ধারিত পথে বেরিয়ে পড়ে যোদ্ধারা। এ সময় নিহত পাকসেনাদের কয়েকটি স্টেনগান এবং স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে যায়। কয়েকটি এল.এম.জিও পাওয়া যায়। এগুলো নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা মুক্তিসেনাদের প্রায় ঘেরাও করেই ফেলে। বাঁশঝাড়ের আড়ালে, আঁকাবাঁকা পথে থানা বাঁক নিয়ে এক সময় পৌঁছে তারা ফুলকুমার নদীর তীরে। সাবধানে অতিক্রম করে পাকিস্তানী হায়েনাগুলোর নাগালের বাইরে চলে যেতে সমর্থ হয় তারা। আর ভুরুঙ্গামারী কলেজ অভ্যন্তরে তখনো পড়ে থাকল একজন মেজরসহ প্রায় ২০ জন পাকসেনার মৃতদেহ।
[৪৭] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত