You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভুরুঙ্গামারীর যুদ্ধ, কুড়িগ্রাম
[অংশগ্রহণকারীর বিবরণ]

প্রচণ্ড আঘাত হেনে ভুরুঙ্গামারীস্থ দখলদার পাকবাহিনীর অবস্থানগুলো ধ্বংস করে ভুরঙ্গামারী উদ্ধার করার জন্য নবেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্দেশ পাওয়া গেল এবং আমরা মরণপণ প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। সেক্টর কমান্ডার এম. কে. বাশার, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জসিসহ ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ সাহেবগঞ্জস্থ আমাদের সাব-সেক্টর হেড কোয়ার্টারে এলেন। আমাদের সঙ্গে ভারতীয় ষষ্ঠ মাউন্টেন ডিভিশনের একটি ব্রিগেড এবং বি.এস.এফ-এর কয়েকটি কোম্পানিও সার্বিক সমর-সজ্জায় সজ্জিত হলো। নেয়া হলো ভুরুঙ্গামারীর দক্ষিণ দিক খোলা রেখে পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বদিক থেকে আক্রমণ রচনার সিদ্ধান্ত। ভুরুঙ্গামারীর পূর্বের মুক্তাঞ্চল সোনাহাট ঘাঁটি থেকে সঙ্কোষ নদী অতিক্রম করে আক্রমণের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আসামের ভারতীয় ৭৮-ব্যাটালিয়ন বি.এস.এফ থাকবে। ৭৮-ব্যাটালিয়নের নেতৃত্বে নিয়োজিত হলেন কর্নেল আর. দাস, তাঁর সঙ্গে ক্যাপ্টেন যাদব ও অন্যান্য অফিসার। পশ্চিম-উত্তর দিক থেকে ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বে থাকলেন ব্রিগেডিয়ার জসি, মেজর জেম্‌স্‌, মেজর গুরুদয়াল সিং, ক্যাপ্টেন শম্ভু, ক্যাপ্টেন মেহেদী ও অন্যান্য অফিসার। সহজে অল্প সময়ের মধ্যে রংপুর উদ্ধার করার জন্য গীতালদহ থেকে মোগলহাট, লালমনিরহাট দিয়ে রংপুর এবং পাকবাহিনীর অবস্থানসমূহ ও ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করা হবে। পাটগ্রাম থেকে বুড়িমারী, কালীগঞ্জ, হাতিবান্দা দিয়ে রংপুর আক্রমণকারীদের সহযোগিতা ও তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার ব্যবস্থাও নেয়া হলো। পাটগ্রাম বা অন্যান্য এলাকার তুলনায় গীতালদহ থেকে রংপুরের দূরত্ব অনেক কম এবং রংপুরে পাকবাহিনীকে আক্রমণের এই রুট উপযোগী ও সুবিধাজনক বিবেচিত হলো। জলপাইগুড়ির হলদিবাড়ির ও হিমকুমারী থেকে জলঢাকা, ডোমার, ডিমলা দিয়ে নীলফামারী এবং সৈয়দপুরে হানাদার পাকবাহিনীর অবস্থানসমূহ আক্রমণ করে এইসব অঞ্চল উদ্ধার ও শত্রুমুক্ত করার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে। এখানে ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বে থাকলেন মেজর ছাতোয়াল সিং, মেজর সিনা ও অন্যান্য অফিসার। প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে তেঁতুলিয়া থেকে পঞ্চগড়, বোদা, দেবীগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও উদ্ধারের এবং খানসামা ও হিলি থেকে দিনাজপুর উদ্ধারের জন্য জোর আক্রমণ প্রস্তুতি। এখানে ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বে থাকলেন ৭১ ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার কাথা পালিয়া এবং ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের মেজর জেনারেল লছমন সিং লেহী। ছয় নম্বর অঞ্চলসমূহে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর নেতৃত্বে থাকলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩১ কোরের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল থাপ্পা। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে থাকলেন এই সব এলাকার আগে উল্লিখিত সাব-সেক্টর কমান্ডার এবং এফ.এফ কমান্ডারবৃন্দ, সেই সঙ্গে ছয় নম্বর সেক্টরের সেক্টর উইং কমান্ডার এম. কে. বাশার।
১১ নভেম্বর রাতে ভুরুঙ্গামারীর পশ্চিম ও উত্তরদিক থেকে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর আমরা আক্রমণ শুরু করলাম। ১২ নবেম্বর সকল আটটায় পাটেশ্বরী রেল স্টেশনে হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর ভারতীয় বিমানবাহিনীর জেট বিমান আক্রমণ চালালো। বিমান থেকে বোমা ও গুলিবর্ষণের ফলে স্টেশনের পশ্চিম পাশের দোতলা বিল্ডিংসহ কয়েকটি পাকা ঘর ধ্বংস হয়ে গেল। আকাশ ও স্থলপথে মিত্র-বাহিনী, সেই সঙ্গে আমাদের তীব্র আক্রমণের ফলে পাটেশ্বরীতে পাকবাহিনীর বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিহত হলো। শেষ পর্যন্ত তারা এখানে টিকতে না পেরে এখানকার অবস্থান ছেড়ে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাটেশ্বরী দখল করে ভুরুঙ্গামারীর প্রায় পুবে এসে শত্রু বাহিনীর ওপর আক্রমণ ও গুলিবর্ষণ করতে থাকে। ১৩ নভেম্বর উল্লিখিত অবস্থান থেকে আমরা প্রবল আক্রমণ শুরু করলাম। মিত্র-বাহিনী কামান, মর্টার, এইচ.এম.জি ও আর. আর. ইত্যাদি ভারি অস্ত্র সহযোগে পাক বাহিনীর ওপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে দিলো। সেই সঙ্গে ভারতীয় যুদ্ধ বিমান আকাশে বার বার চক্কর দিতে থাকে। তবে একদিন আগে থেকেই মিত্র বাহিনীর বিমান শত্রুদের অবস্থানের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে দিয়েছিল। সন্ধ্যার আগে আমরা ভুরুঙ্গামারীর প্রায় কাছে এসে উল্লিখিত তিনদিক থেকে বর্বর বাহিনীকে ঘিরে তাদের অবস্থানের ওপর আঘাত হেনে চলেছি। মধ্যরাতে শত্রু বাহিনীর গুলির আওয়াজ স্তিমিত হয়ে এল। ভোর হওয়ার আগেই পাকবাহিনীর গুলির আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। ১৪ নভেম্বর পুবের আকাশ ফরসা করে লাল রক্তিম সূর্য হেলেদুলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে আমরা ভুরুঙ্গামারীতে ঢুকে পড়লাম। পাকবাহিনী যত্রতত্র পুঁতে রাখা মাইনের কারণে জয়োল্লাসরত মুক্তিযোদ্ধাদের সড়ক ব্যতীত মাঠে বা জঙ্গলে যেতে নিষেধ করা হলো। ভুরুঙ্গামারী হাই স্কুল ও সিও অফিসের কাছে থেকে ষাটজন ই.পি. ক্যাফ এবং প্রায় তিরিশ/চল্লিশজন পাকিস্তানী বর্বর পশু বাহিনীর সদস্যকে ঘেরাও করে ধরা হলো। এদের অস্ত্রের গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় মিত্র বাহিনী ধৃত নরপশুদের হত্যা করার সুযোগ না দিয়ে তাদেরকে ভারতে নিয়ে চলে গেল। পাকিস্তানী নরপিশাচ বাহিনীর দুশ্চরিত্র ক্যাপ্টেন আতাউল্লা খান ও একজন নির্যাতিতা বাঙালি মহিলাকে বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় সিও অফিসের পাশের এক বিধ্বস্ত বাঙ্কারে পাওয়া গেল। নরপশু ক্যাপ্টেন এই মহিলাকে জড়িয়ে ধরে ছিল এবং এভাবেই নিহত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় চল্লিশ/পঞ্চাশ জন শত্রু-সেনা নিহত হয়। ভুরুঙ্গামারীর পুব দিকের চৌমাথায় ও কলেজের দক্ষিণে আমরা অবস্থান গ্রহণ করলাম। মাতৃভূমি জন্মভূমি উদ্ধার করার আনন্দে চোখের জল বের হয়ে এল। স্বাধীন বাংলার পবিত্র জন্মভূমির মাটি হাতের মুঠোয় নিয়ে বুকে আর কপালে মাখলাম। গাঢ় সবুজ ক্ষেত্র আর রক্তলাল বৃত্তের মাঝে সোনালি রং দিয়ে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্রবিশিষ্ট স্বাধীন বাংলার পতাকা সিও অফিসের সম্মুখে তুলে দিলাম। বিজয়োল্লাসে পতাকা পৎ পৎ করে উড়তে থাকলো। এই আনন্দ আর অনুভূতি শুধু অনুভবই করা যায়, প্রকাশ করা সম্ভব নয়। পাকা রাস্তা দিয়ে সকাল ন’টায় ভুরুঙ্গামারীর পুবে আমাদের অবস্থানে যাচ্ছিলাম। এই সময় ওয়্যারলেসে পেছন থেকে সংবাদ দেয়া হলো, আমাকে সিও অফিসের কাছে যেতে হবে। সিও’র বাসভবনের দোতলায় জানালার ফাঁক দিয়ে কয়েকজন মহিলাকে দেখা গেল। আমরা কয়েকজন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখলাম, বাইরে থেকে দরজায় তালা আটকানো। রাইফেলের বাঁট দিয়ে তালা ভেঙে ঘরের ভেতরে ঢুকে চোখ বন্ধ করে বের হয়ে এসে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। কয়েক মুহূর্ত এভাবে কাটলো। ঘরের ভেতর চারজন মেয়ে, দু’জন সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় এবং দু’জন শুধু জাঙ্গিয়া পরে রয়েছে। আমাদের চারটি লুঙ্গি ও চারটি শতরঞ্জি দরজার বাইরে থেকে ঘরের ভেতরে ছুঁড়ে দিলাম। আমরা দরজার বাইরে থেকে মেয়েগুলোর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মেয়েগুলো কথা বলতে পারছিল না। তাদের সমগ্র শরীর নরপশু হিংস্র হায়েনা শয়তানদের নির্যাতনে ক্ষত- বিক্ষত হয়ে গেছে। তাদের এক একজন প্রায় ৬/৭ মাসের গর্ভবতী। আমি এই দৃশ্য দেখে নীরব হয়ে গেলাম, আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিল না। একজনের সামান্য পরিচয় পাওয়া গেল, ময়মনসিংহ কলেজের ছাত্রী। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরের গাড়িতে করে তাদেরকে চিকিৎসার জন্য সঙ্গে সঙ্গে ভারত নিয়ে যাওয়া হলো। একইভাবে ভুরুঙ্গামারী হাই স্কুলে তালাবদ্ধ একটি কক্ষ থেকে ষোলজন নির্যাতিতা মহিলাকে উদ্ধার করা হলো। তাদেরকেও ভারতে নিয়ে যাওয়া হলো। সিও অফিসের দোতলায় দক্ষিণ সিঁড়ির পাশের কক্ষে দেখা গেল, কক্ষের সমস্ত মেঝে জুড়ে চাপ চাপ রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। ছেঁড়া শাড়ি- ব্লাউজ, পেটিকোট, ব্রেশিয়ার, মেয়েদের ছেঁড়া চুল কক্ষের মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। পুব পাশে জানালার লোহার রডের সঙ্গে সূতার রশি বাঁধা রয়েছে। এই রশি দিয়ে মেয়েদেরকে বেঁধে শয়তানরা উপর্যুপরি ধর্ষণ ও পাশবিক অত্যাচার চালাতো। চোখে পড়লো কক্ষের উত্তর দেয়ালে রক্ত দিয়ে মোটা অক্ষরে ৭/৮ ইঞ্চি দূরত্ব রেখে লেখা ‘জ-বা’ শব্দ। সম্ভবত রক্তাক্ত আঙুল দিয়ে লিখেছে। যে মেয়েটি লিখেছে, তার নাম হয়তো জবা অথবা সে বাঙালির প্রাণের শব্দ “জয় বাংলা” লেখার চেষ্টা করেছিল। এই দিনই আমরা জয়মনিরহাটের দিকে অগ্রসর হলাম এবং বিকেলে এখানে অবস্থান গ্রহণ করলাম। চৌমাথা থেকে সোনাহাট যাওয়ার রাস্তার দক্ষিণে এবং জয়মনিরহাট রাস্তার পুব পাশে প্রায় চার/পাঁচ বিঘা জায়গা জুড়ে পাকবাহিনী মাইন পুঁতে রেখেছে। এই মাইন স্থাপিত স্থানটি তার দিয়ে ঘিরে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। পাকা রাস্তার উভয় পাশের ঘাসের নিচের মাটিতেও শত্রু বাহিনী মাইন পুঁতে রেখেছিল। মিত্র বাহিনীর সদস্যরা মাইন ডিটেক্টর দিয়ে এইসব মাইন অপসারণ করতে থাকে। আমাদের প্রচণ্ড আঘাতে মার খেয়ে পাকিস্তানী দস্যু বাহিনী পিছু হটে রায়গঞ্জে অবস্থান নেয়। ১৬ নভেম্বর আমরা আন্ধারী ঝাড়ে অবস্থান গ্রহণ করে রায়গঞ্জে দস্যু বাহিনীর ওপর আক্রমণ ও গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখলাম। ১৯ নভেম্বর রাতে রায়গঞ্জের পশ্চিম ও পূর্বদিক এবং উত্তরে আন্ধারী ঝাড়সহ তিনদিক থেকে আক্রমণ রচনা করলাম। ফুলকুমার নদী অতিক্রম করে পরিকল্পনা অনুযায়ী মধ্যরাত হতেই রায়গঞ্জে শত্রু বাহিনীর অবস্থান ঘিরে প্রচণ্ড আক্রমণ চালানো হলো। ভোর রাত থেকে শত্রুদের গুলির শব্দ নীরব হয়ে এল। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা রায়গঞ্জে ঢুকে পড়লাম। বাজার, হাসপাতাল ও রাস্ত ার পাশে পঁচিশ/তিরিশজন আহত বর্বর শত্রু-সেনা কাতরাচ্ছিল। আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণ ও গুলিবর্ষণের মুখে শত্রুরা তাদের সাথীদেরকে ফেলে রেখে গেছে। কয়েকজন আহত নরপশু শত্রুকে আমরা গুলি করে হত্যা করলাম। ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সদস্যরা বাকি শত্রুদেরকে হত্যা করতে দিল না। রায়গঞ্জের যুদ্ধে প্রায় তিরিশ/পঁয়ত্রিশজন নরপশু পাকসেনা নিহত হয়। রায়গঞ্জ শত্রুমুক্ত হলো। ঠিক এই পর্যায়ে শত্রু-সেনার গুলিতে লেঃ সামাদের শহীদ হওয়ার সংবাদ একজন দৌড়ে এসে জানালো। ফুলকুমার নদীর উত্তর পাড়ে পাকা রাস্তার পাশের চারজন শহীদের মরদেহ উদ্ধার করলাম। শত্রু বাহিনী রায়গঞ্জ থেকে চলে গেছে মনে করে ২০ নভেম্বর সকাল সাড়ে পাঁচটায় লেঃ সামাদ ও ভারতীয় বাহিনীর মেজর জেমস সোজা পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে জীপ নিয়ে রায়গঞ্জের দিকে অগ্রসর হন। রায়গঞ্জ পুলের প্রায় কাছে আসতেই পুলের অপর পার থেকে শত্রু বাহিনী এম.এম.জি দিয়ে অগ্রসরমান লে. সামাদের প্রতি গুলিবর্ষণ করে। শত্রুদের এই গুলিতে লেঃ সামাদ, মেজর জেমস, রামখানার দুই ভাই আবুল হোসেন ও আবদুল আজিজ এবং একজন ভারতীয় সৈন্য শহীদ হলেন। মাতৃভূমি উদ্ধারের জয়োল্লাস ও আনন্দের মাঝে বিষাদ নেমে এল। বীর শহীদ আব্দুল আজিজ, আবুল হোসেন ও শহীদ লেঃ সামাদকে জয়মনিরহাট মসজিদের পাশে বীরের মর্যাদায় সমাহিত করে আমরা তাঁদের শেষ বিদায় জানালাম। জয়মনিরহাটের নতুন নামকরণ করা হলো শহীদ সামাদনগর। মিত্র বাহিনীর বীরযোদ্ধা শহীদ মেজর জেম্‌স্‌ ও মিত্র বাহিনীর শহীদ অন্য সদস্যদের মরদেহ মিত্র বাহিনী নিয়ে গেল। রায়গঞ্জে আমরা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করলাম। ২১ নভেম্বর আমরা নাগেশ্বরী উদ্ধার করলাম। ভিরবন্দ, নুন খাওয়া, যাত্রাপুর ও পাটেশ্বরী মুক্ত করে ২৩ নভেম্বর আমরা পাটেশ্বরী এবং ধরলা নদীর উত্তর পাশে অবস্থান গ্রহণ করে ধরলার উত্তর দিকের দু’টি থানা- ভুরুঙ্গামারী ও নাগেশ্বরী উদ্ধার করে ফুলবাড়ি থানাসহ তিনটি থানা আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখলাম। এর আগেই উল্লেখ করেছি, ফুলবাড়ি থানা শত্রু বাহিনী দখল করতে পারেনি। আমরা বরাবর এই থানা মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। হানাদার শত্রু বাহিনীর অবস্থান কুড়িগ্রাম আক্রমণ করে কুড়িগ্রাম উদ্ধারের লক্ষ্যে ২৪ নভেম্বর রাতে ধরলা নদী পার হয়ে কুড়িগ্রামের পশ্চিমে হরিকেশ ও পুবে মোগলবাছা এবং পাটেশ্বরীর ঘাট দিয়ে নদী অতিক্রম করে মিত্র বাহিনীসহ আমরা তিনদিক থেকে শত্রু বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করলাম। গ্রামের সাধারণ খেটে-খাওয়া শত শত মানুষ আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে থাকে। ২৫ নভেম্বর সকালে মিত্র বাহিনীর বিমান কুড়িগ্রাম শহরের ওপর চক্কর দিতে থাকে। সকাল এগারোটার মধ্যে পাকিস্তানী বর্বর শত্রু বাহিনী কুড়িগ্রাম থেকে পালিয়ে চলে যায়। আমরা ২৫ নভেম্বর কুড়িগ্রাম উদ্ধার করে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসলাম। সাথী মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে কুড়িগ্রাম কোর্ট ভবনে বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলার পতাকা আমি নিজে উত্তোলন করলাম। টগরাইহাট, কাঁঠালবাড়ি, বড়বাড়ি, শিঙ্গের ডাববি, উলিপুর, চিলমারী একের পর এক আমরা উদ্ধার করে গেলাম এবং পাক হানাদার দস্যু বাহিনীকে বিতাড়িত করে ২৯ নভেম্বর তিস্তা উদ্ধার করে তিস্তা এবং তিস্তা পুলের কাছে নদীর পারে আমরা অবস্থান গ্রহণ করলাম। পাকবাহিনী তিস্তা নদী অতিক্রম করে কাউনিয়ায় অবস্থান নিয়ে এই দিন বিকেলে তিস্তা পুলের পশ্চিম পার ভেঙে দিল, যাতে আমরা তিস্তা নদী অতিক্রম করে তাদেরকে ধাওয়া এবং আক্রমণ করতে না পারি। ভুরুঙ্গামারী, রায়গঞ্জ ও কুড়িগ্রামে পাকবাহিনীর কাছ থেকে আমরা প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র, গোলা-বারুদ, ছয়টি জীপ ও দশটি মিলিটারি ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন এবং চাইনিজ এস.এল.আর, চাইনিজ এল.এম.জি, বৃটিশ এল. এম. জি, ২৬ ইঞ্চি পাউডার কামান, বিভিন্ন প্রকার মর্টার, এম. এম. জি, এইচ. এম.জি, স্টেনগান, বিভিন্ন প্রকার রাইফেল, রকেট ল্যান্সার, গ্রেনেড, মাইন, এক্সপ্লোসিভ, এয়ারবাস্ট কামান, সেল, পোর্টেবল ও দূরপাল্লার ওয়্যারলেস ইত্যাদি দখল করতে সক্ষম হই। কুড়িগ্রামে আমাদের হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হলো। বি.এস.এফ কমান্ডার কর্নেল আর. দাস তার দল নিয়ে কুড়িগ্রাম ফায়ার ব্রিগেডে অবস্থান গ্রহণ করলেন। আমরা (এফ.এফ) ভোকেশনাল ট্রেনিং স্কুল, পিটিআই, ঘোষপাড়া ডাকবাংলো, ওয়াপদা ডাকবাংলো, সবুজ পাড়ায় নাসির সোপ ফ্যাক্টরির অবাঙালি মালিকের বাড়ি ও পার্শ্ববর্তী বিহারিদের বাড়ি, দাদা কোম্পানি ও শহরের
বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিলাম। কোর্ট বিল্ডিং, নিউটাউনস্থ অফিসার্স কোয়ার্টার, মিতালী সিনেমা হলের পাশে মঞ্জু মণ্ডলের বাড়ি এবং খলিলগঞ্জে এম. এফ সদস্যরা (ই.পি.আর) অবস্থান গ্রহণ করে। বি.এল.এফ- এর কয়েকটি দলকে মোল্লাপাড়া স্থ আনসার মিঞার বাড়ি ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান নেয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম। তিস্তার অবস্থান সুদৃঢ় করার পর সমগ্র কুড়িগ্রাম মহকুমায় আমাদের বিজয় ঘোষিত হলো। আমাদের নিয়ন্ত্রিত মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হলো। কুড়িগ্রাম মহকুমা উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীরা দলে দলে নিজ নিজ বাড়ি-ঘরে ফিরে আসতে থাকে। কুড়িগ্রামের দ্বিতীয় অফিসার আব্দুল হালিম, ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল লতিফ, জিয়াউদ্দিন আহমেদসহ ভারতে আশ্রয় নেয়া অফিসারবৃন্দকে কুড়িগ্রাম নিয়ে আসা হলো। তাঁদের সহায়তায় আমরা বেসামরিক প্রশাসন গড়ে তুললাম। ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ি, উলিপুর, চিলমারী, লালমনিরহাট ও রৌমারীতে বেসামরিক প্রশাসন গড়ে তোলা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য এইসব থানায় অন্তত একটি করে এফ. এফ. কোম্পানি রাখা হলো। এমনিভাবে বি.এল.এফ-এর প্রত্যেক থানার দলকে তাদের স্ব-স্ব থানায় অবস্থানের জন্য আমি নির্দেশ প্রদান করলাম। ভুরুঙ্গামারী বি.এল.এফ সদস্য ওসমান, আকবর, মোজাম্মেল, রশিদসহ কুড়িগ্রাম থানার বি.এল.এফ সদস্যদের আমার নিজের কাছে রাখলাম। প্রথমে আমি সবুজপাড়ায় নাসের সোপ ফ্যাক্টরির মালিকের বাসায় এবং পরে ঘোষপাড়া স্থ ডাকবাংলোতে অবস্থান গ্রহণ করলাম। পাকবাহিনী স্থাপিত দাদা কোম্পানি স্থ রাজাকার হেড কোয়ার্টার থেকে রাজাকারদের তালিকা ও অতুল চৌধুরীর বাড়িতে স্থাপিত শান্তি কমিটির অফিস থেকে শান্তি কমিটির কর্মকর্তাদের তালিকা এবং দলিলপত্র আমরা সংগ্রহ করলাম। দাদা কোম্পানিস্থ রাজাকার হেড কোয়ার্টারে প্রাপ্ত নগদ চব্বিশ হাজার টাকা ও অন্যান্য প্রাপ্ত জিনিসপত্র পাক দস্যুবাহিনী এবং তাদের অনুচর দালালরা যেসব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, সেসব এলাকায় আমরা বিতরণ করলাম। জনাব শামছুল হক চৌধুরী এম.পি.এ, মোজাহার চৌধুরী এম.এন.এ, অন্যান্য এম.পি.এ ও এম.এন.এ. এবং আমাদের সার্বিক সহায়তায় জনাব আব্দুল হালিম, দ্বিতীয় অফিসার ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল লতিফ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ, মহকুমা খাদ্য কর্মকর্তা কামাল সাহেব, অন্যান্য অফিসার ও কর্মকর্তা সমন্বয়ে বেসামরিক প্রশাসন গড়ে তুললেন। জনাব শামছুল হক চৌধুরী মূলত কুড়িগ্রাম মহকুমার বেসামরিক প্রশাসনের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। এখানে উল্লেখ্য, কুড়িগ্রামে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ই.পি.আর সুবেদার আরব আলী, সুবেদার মোস্তফা এবং সুবেদার শামছুল কিছু সমস্যার সৃষ্টি করে। আমি সুবেদার শামছুল হককে মঞ্জু মণ্ডলের বাড়ি থেকে কোর্ট ভবনে স্থানান্তর করলাম। তারা বেশ কিছু অন্যায় কাজ করার চেষ্টা করলে আমি তাতে বাধা দিয়ে অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করি। প্রফেসর হায়দার আলী ও ঠিকাদার তোসাদ্দাক হোসেন এইসব সুবেদারকে অন্যায় কাজ করতে ইন্ধন জোগায়। ইতোমধ্যে এফ.এফ মতিউর রহমান ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন শিখ সদস্য ভুরুঙ্গামারীর পুবদিকের চৌমাথায় রাস্তার পাশে কথা বলতে বলতে যেই ঘাসের ওপর পা রেখেছে, সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনীর পুঁতে রাখা একটি এ্যান্টি পার্সোনাল মাইন বিস্ফোরিত হয়ে মতিউর রহমানের ডান পা এবং মিত্র শিখসেনার একটি পা উড়ে যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরের সদস্যরা তাঁদেরকে সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় হাসপাতালে প্রেরণ করেন। এরপর মাইন অপসারণের কাজে নিয়োজিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা দ্রুত সেইসব মাইন অপসারণ করেন। এদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সদস্যরা লালমনিরহাট বরাবর তিস্তা নদী অতিক্রম করে হারাগাছ দিয়ে, তিস্তায় তিস্তা নদী অতিক্রম করে কাউনিয়া এবং মাহিগঞ্জ দিয়ে রংপুরে দস্যু পাকিস্তানী বাহিনীকে অবরোধ করে ফেলে। অন্যদিকে জলঢাকা, ডোমার, ডিমলা হয়ে নীলফামারী ও সৈয়দপুর এবং অপর দল পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর হয়ে নীলফামারী ও সৈয়দপুর উদ্ধারশেষে রংপুর অবরোধ করে। একটি দল হিলি থেকে পীরগঞ্জ দিয়ে রংপুর অবরোধ এবং অপর দল হিলি থেকে পলাশবাড়ির ভেতর দিয়ে গাইবান্ধা পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে গাইবান্ধা ও ফুলছড়ি ঘাট উদ্ধার করে। এভাবে অবরোধ সৃষ্টি করে রংপুর থেকে নরপশু পাকিস্তানী দস্যুদের পলায়নের সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হলো। এছাড়া আসাম এলাকা থেকে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী বাহাদুরাবাদ দিয়ে জামালপুর ও ময়মনসিংহ অভিমুখে অগ্রসর হয়।
[২] আখতারুজ্জামান মন্ডল
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!