You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভদ্রঘাট যুদ্ধ, সিরাজগঞ্জ

১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই যুদ্ধ হয়। এটি সিরাজগঞ্জ জেলার দ্বিতীয় যুদ্ধ। ভদ্রঘাট সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানায় অবস্থিত। সিরাজগঞ্জ থেকে ভদ্রঘাটের দূরত্ব আনুমানিক ১২ কিলোমিটার। ঘটনাস্থল ঢাকা-বগুড়া রোডসংলগ্ন নকলা ফেরিঘাট (বর্তমানে ব্রিজ) নামক স্থানের পার্শ্ববর্তী। ১৯৭১ সালের জুন মাসে কতিপয় সাহসী তরুণের নেতৃত্বে ভদ্রঘাট ইউনিয়ন কালিবাড়ি ভদ্রঘাট, তেনাছাটা ভদ্রঘাট, ধামখোল গ্রামকে নিয়ে একটি অস্থায়ী যুদ্ধশিবির গঠিত হয়, যা পরে পলাশডাঙ্গা যুদ্ধশিবির নামে নামকরণ হয়। পরবর্তীতে কতিপয় স্বার্থান্বেষী ও দুষ্কৃতকারীর সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনী এই সংঘবদ্ধ মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্যকে বিফল করে দেয়ার জন্য এ স্থানে আক্রমণ চালায় এবং তা প্রতিহত করতেই এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রাথমিক সংগঠনে ছিলেন সোহরাব আলী সরকার (তৎকালীন সিরাজগঞ্জ কলেজের ভিপি), মনিরুল কবির, ছাত্রনেতা আজিজ সরকার, শফিউল ইসলাম (শফি), লুৎফর রহমান (মাখন)। ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পরে এই ক্যাম্পে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান (অরুণ) যিনি তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্পোরাল (নং ৬২৭০৭৭৭,৩০ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন) পদে নিযুক্ত ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বালুঘাটের কুমরাইল ট্রেনিং ক্যাম্পে ১ মাস প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই মোহাম্মদ আলী (বাঘা) যোগ দেন। তিনি ব্রিটিশ এলএমজি নিয়ে যুদ্ধ করেছেন (অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করতেন বলে সহযোদ্ধারা তাকে বাঘা বলে ডাকতেন)। এখানে উল্লেখ্য যে, লুৎফর রহমান (অরুণ) ভারতে যাওয়ার পূর্বে কিছু অস্ত্র এবং গোলাবারুদ (বাঘাবাড়ী থেকে আনা) সিরাজগঞ্জের চীলগাছা গ্রামে তৎকালীন ছাত্রনেতা মরহুম রফিকুল ইসলামের বাড়িতে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। এই অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়েই এই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো অনেক বাঙালি বীর এই ক্যাম্পে যোগ দেয় এবং প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে। এই খবর একসময় পাক সেনাবাহিনীর কানে পৌঁছে। ১৯৭১ সালের ১৭ জুন ভোরের দিকে পাক হানাদার বাহিনী এই ক্যাম্পে পরিকল্পিতভাবে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা ছিল সদা প্রস্তুত। হানাদার বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে কমান্ডার লুৎফর রহমান (অরুণ) সবাইকে কিছু জরুরি নির্দেশ দিয়ে পূর্বে প্রস্তুতকৃত পরিখায় অবস্থান গ্রহণ করতে বলেন। মুক্তিযোদ্ধারা তেনাচাটা ভদ্রঘাট থেকে কালিবাড়ি পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়। কালিবাড়ির সামনে ছিল পাটক্ষেত এবং পেছনে অর্ধেক মাইল পর্যন্ত ছিল জলমগ্ন। মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণা ছিল এই স্থান থেকে শত্রুদের আক্রমণের সম্ভাবনা খুব কম যেহেতু জায়গাটা ছিল দুর্গম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হানাদার বাহিনী এই দিক থেকেই আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসে। কমান্ডার গাজী লুৎফর রহমান (অরুণ) চাইনিজ রাইফেল দিয়ে ফায়ার শুরু করার চেষ্টা করেন। কিন্তু রাইফেলে সমস্যা দেখা দেয়ায় তিনি তার এক সহকর্মীর কাছ থেকে একটি মাসকেট রাইফেল নেন এবং শত্রু ১০০ গজের মধ্যে আসতেই তিনি আল্লাহর নাম নিয়ে শত্রুর উদ্দেশে প্রথম গুলি করেন। এই হঠাৎ আক্রমণের জন্য শত্রুরা প্রস্তুত ছিল না। দুই-তিনজন হানাদার বাহিনী গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে এবং বাকিরা আড়ালে অবস্থান গ্রহণ করে৷ এই স্বল্প অস্ত্র দিয়েই কিছু সময় ধরে গুলি বিনিময় হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ সৈনিক না থাকার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রে অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দেয় কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় মনোবল এবং একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাসদস্য লুৎফর রহমান (অরুণ)-এর সহায়তায় এসব সমস্যা সমাধান যোদ্ধারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। শত্রুপক্ষ সুবিধা করতে না পেরে শত্রুর একজন ওয়ারলেস অপারেটর গাছে উঠে বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। এরপর গোলাগুলি কিছু সময়ের জন্য থেমে যায়। মো. কামাল নামের এক মুক্তিযোদ্ধা আমগাছে উঠতে যাওয়া এক শত্রুকে লক্ষ্য করে পয়েন্ট টু টু রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শত্রুরা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের স্বল্পতা সম্পর্কে অবগত হয় এবং প্রবল গুলিবর্ষণ করে। সেই মুহূর্তে ২ নং এবং ৩ নং প্লাটুনের কোনো সাহায্য না পেয়ে মুক্তিবাহিনী উপায়হীন হয়ে পড়ে। ঠিক তখনি ২ নং প্লাটুন থেকে ফায়ার দেয়া শুরু হয়। পাক হানাদার বাহিনী এই ফায়ারের অবস্থান বুঝতে না পেরে তারা আড়ালে অবস্থান নেয় এবং ফায়ার বন্ধ করে। তখন ১নং প্লাটুন অর্থাৎ লুৎফর রহমান (অরুণ)-এর গ্রুপ ফায়ার দিতে দিতে পিছু হটা শুরু করে। এই যুদ্ধে প্রায় ১১ জন পাকসেনা নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়। যেহেতু ২ নং এবং ৩ নং প্লাটুন যুদ্ধের শুরুতে ১ নং প্লাটুনকে সাহায্য করতে পারেনি তাই ১ নং প্লাটুন কালিবাড়ি থেকে পিছু হটে নিরাপদ আশ্রয়ে যায় এবং পাকসেনারা এই সুযোগ নিয়ে সেই স্থানের শত শত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং অনেক লুটপাট করে। এ গ্রামের মাতবর মছের উদ্দীন সরকার এবং তার দুই ভাই মাদার বক্স সরকার ও আছের উদ্দীন সরকারকে হানাদার বাহিনী হত্যা করে। জগৎগাতী গ্রামে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও হানাদার বাহিনীর দোসর কুখ্যাত মজিবুর রহমানের সহায়তায় আরো একটি পরিবারের চারজনকে হানাদার বাহিনী হত্যা করে। তারা হলেন আজাহার আলী, ফজল রহমান, মংগল হোসেন ও আবুল হোসেন ভূঁইয়া। তাদের অপরাধ ছিল যে তারা মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন।
[৫৯৬] সংকলন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!