ভবেরচর এলাকার শেষ যুদ্ধ, মুন্সিগঞ্জ
ডিসেম্বরের শুরুতেই পাকিস্তানীরা তাদের সম্ভাব্য পরিণতি উপলব্ধি করতে শুরু করে। কুমিল্লা সেনানিবাসের ইউনিট দাউদকান্দি এলাকায় মোতায়েন ছিল। ঢাকার ইউনিট মোতায়েন ছিল মেঘনা নদীর পশ্চিম এলাকায় অর্থাৎ বাউসিয়া থেকে মহাসড়ক বরাবর ঢাকা পর্যন্ত। ডিসেম্বরের সন্ধ্যার মধ্যে ভারতীয় বাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস অবরোধ করে ফেলে। ফলে এ সেনানিবাস থেকে বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন শত্রুর ক্যাম্পগুলোতে খাবার, গোলাবারুদসহ সব সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে বিচ্ছিন্ন ক্যাম্পগুলো থেকে আহত-নিহত পাঠানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাস্তবিক অর্থেই পাকিস্তানীরা তাদের ক্যাম্পে অবরুদ্ধ হয়ে যায়। তাদের ক্যাম্প ছাড়া বাকি এলাকা চলে আসে মুক্তিবাহিনীর দখলে। পাকিস্তানীরা তাদের খাবার সংগ্রহের জন্য আশেপাশের বাজার বা এলাকায় বের হতে পারত না মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ভয়ে। এ অবস্থায় তারা চেষ্টা করে ছোট ছোট অবস্থান ত্যাগ করে আশেপাশের ক্যাম্পে গিয়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে। গজারিয়া- দাউদকান্দি এলাকা নদীবহুল হওয়ায় ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়ক ছাড়া তাদের চলাচলেরও কোনো উপায় ছিল না। ৫ ডিসেম্বর ভবেরচর কাঠের ব্রিজে আগুন দেয়া হয়। উদ্দেশ্য পাকিস্তানীরা যেন ঢাকার দিকে যেতে না পারে। ব্রিজটি ভস্মিভূত না হয়ে ব্যবহারযোগ্য থেকে যায়। ৬ ডিসেম্বর শত্রুরা ভবেরচর ব্রিজের আনুমানিক ১ কি.মি. ঢাকার দিকে অবস্থিত আলীপুর গ্রামে আগুন দেয় এবং ১৩ জন লোককে হত্যা করে। আগের দিনও তাদের ৭ জনের একটি দল একটি মাইক্রোবাসে ভবেরচর কাঠের ব্রিজ এলাকায় এসে শিশু-কিশোরসহ বহু লোককে গুলি করে হত্যা করে। কিছু কিশোর ছেলে ভয়ে পাশের কবরস্থানে কবরের ভেতর আশ্রয় নেয়। এই নরপশুরা তাদের কবরের ভেতর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। একই মাইক্রোবাসে করে এরা চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ পেয়ে ছুটে আসে। কিছুক্ষণ পর দুই ট্রাক পাকিস্তানী সৈন্য আসে ঢাকার দিক থেকে। এরা কাঠের ব্রিজের কাছে এসে হেঁটে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনী এদের ওপর গুলি ছুড়ে। পাকিস্তানীরাও পাল্টা জবাব দেয়। অবস্থা অনুকূলে যাবে না সন্দেহে ওরা ভাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে ঢাকার দিকে ফেরত যায়। ব্রিজের বাঙ্কারে অবস্থিত শত্রু সৈন্যরা সেগুলো ছেড়ে বাউসিয়ার দিকে চলে যায় এবং থেকে থেকে বিভিন্ন অবস্থান থেকে গুলি করতে থাকে। এভাবে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। পর্যায়ক্রমে অবশিষ্ট পাকিস্তানী সৈন্যরা নৌযানের অভাবে মেঘনা নদী পার হতে না পেরে বাউসিয়ার চর এলাকায় আশ্রয় নেয়। ৯ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে চর এলাকায় পাকসেনাদের আত্মসমর্পণ করাতে যান। তারা তখন ফরাজিকান্দির চরে অবস্থান করছিল। মুক্তিবাহিনীর আগমন দেখে শত্রু সৈন্যরা তাদের অস্ত্র একস্থানে স্তূপকারে রেখে একটু দূরে মাথার ওপর হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। এটা লক্ষ্য করা যায়নি যে শত্রুর এক সৈনিক খড়ের নিচের গ্রেনেডের পিন খুলে লিভার পা দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছে। নজরুলরা এগিয়ে কাছে গেলে সে গ্রেনেডটির ওপর থেকে তার পা সরিয়ে নেয় এবং তারা সবাই তৎক্ষণাৎ নদীর দিকে লাফিয়ে পড়ে। প্রচণ্ড শব্দে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়। দলনেতা নজরুল সবাইকে সতর্ক করে পজিশনে যেতে বলেন। কিন্তু ততক্ষণে গ্রেনেডের স্পি-ন্টারের আঘাতে তার দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য ৬ জন আঘাত পায় কিন্তু কারোই অবস্থা মারা যাবার মতো নয়। পরবর্তী সব (মোট ১১ জন) সৈন্যকে হত্যা করে তাদের সব অস্ত্র দখল
করা হয়।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত