ভরতেরকান্দি অপারেশন, নরসিংদী
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। শিবপুর থানার সর্ব দক্ষিণে ভরতেরকান্দি গ্রাম। এই গ্রামের পাশ দিয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী প্রবাহিত। নদীর ওপারে নরসিংদী সদর। এই নদীর উপরেই ভরতেরকান্দি সেতু।
সশস্ত্র প্রতিরোধ সর্বত্র ব্যাপক আকারে বিস্তৃতি লাভ করছে৷ পাকিস্তানী শত্রু বাহিনী পলায়ন রাস্তা রক্ষার্থে সর্বদা তটস্থ। নরসিংদী সদর থেকে শিবপুর থানায় অবস্থিত হানাদার বাহিনীর রশদ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয় নরসিংদী শিবপুর রাস্তার মাধ্যমে। টহল দিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাতে থাকে হানাদার বাহিনী। সশস্ত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে পাকিস্তানী বাহিনী তখন দিশেহারা। তাই সেতু ও কালভার্ট রক্ষার্থে তারা বেশি ব্যস্ত। তারা ভরতেরকান্দি সেতু রক্ষার্থে এর দুই পাশে বাংকার নির্মাণ করে। পাহারা চলে দিন রাত। এই বুঝি মুক্তিযোদ্ধারা এসে আক্রমণ করলো, এই বুঝি ধ্বংস করে দিল সেতু এবং ছিনিয়ে নিল অস্ত্র গোলাবারুদ। হাবিলদার মজনু মৃধা এগিয়ে এলেন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। শুরু হলো শত্রুর গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখা। সংগ্রহ করা হলো ডিউটি পরিবর্তনের সময়। পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনার পর সকলেই প্রস্তুত অপারেশনের জন্য। রাতের অন্ধকারে শুরু হলো অগ্রযাত্রা ভরতেরকান্দি সেতু অভিমুখে। দলটিতে ছিল ১২ জন। কমান্ডার হাবিলদার মজনু মৃধা। অস্ত্র ছিল ২টা এলএমজি, ২টা স্টেন, ১টা এসএমজি এবং রাইফেল ৭টা। আরো ছিল কয়েকটা হ্যান্ড গ্রেনেড ও কিছু বিস্ফোরক। সেতু রক্ষায় সশস্ত্র প্রহরায় ছিল শত্রু। উভয় পার্শ্বে বাংকারে ছিল তাদের শক্ত অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সেতুর দু’পাশ থেকে আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী দু’গ্রুপে ৬জন করে ২টি দলে ভাগ হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারেই নিজস্ব অবস্থানে দখল সম্পন্ন করেন সকলেই। নিঃশব্দ অবস্থান দখলের ফলে শত্রুবাহিনী একটুও বুঝতে সক্ষম হয় নাই মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে। এবার শুরু হয় অপেক্ষার পালা। ক্রমান্বয়ে কেটে যায় রাতের অন্ধকার। ভোরের আকাশে তখনও সূর্য উঠে নাই। এসে যায় সেই প্রতীক্ষার মুহূর্ত। হাবিলদার মজনু মৃধার সামনে অবস্থিত বাংকার থেকে শত্রু প্রহরী বের হয়ে আসে। কিন্তু সেতুর অপর পাশের বাংকার থেকে তখনও কেউ বের হয় নাই। হঠাৎ ভোরের নিঃশব্দতা ও নির্জনতা ভঙ্গ করে হাবিলদার মজনু মৃধার এসএমজি গর্জে উঠে। সাথে সাথে চারজন পাকিস্তানী সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেতুর অপর পাড়েও শুরু হয় শত্রুর উপর প্রচণ্ড গুলি। প্রায় ২০/২৫ মিনিট ধরে চলে তুমুল গোলাগুলি। গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা বাংকারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা এরই মধ্যে বাংকার ও ব্রিজ লক্ষ করে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। ব্রিজে অবস্থিত প্রহরী এরই মধ্যে পলায়ন করে। পাকিস্তান বাহিনী পলায়ন এর পর মুক্তিযোদ্ধারা সেতুতে বিস্ফোরক লাগানোর কাজ শুরু করে। তারপর সম্পূর্ণ বিস্ফোরক ফাটিয়ে সেতুটি মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করে দেয়৷
এই অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা কার্যকরীভাবে ভরতেরকান্দি সেতু ধ্বংস করে। এখানে ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্য মারা যায়। বাংকার থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সংগ্রহ করে ৩টি চাইনিজ রাইফেল ও ৪ বাক্স গুলি। আহত অবস্থায় ১ জন পাকিস্তানী সৈন্য ধরা পড়ে। কিন্তু পরবর্তীতে সেও মারা যায়। এটা একটা কার্যকরী, স্বার্থক ও সফল অভিযান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। অপারেশনে যাওয়ার আগে কমান্ডার নিজাম তাঁর প্রণীত পরিকল্পনার আওতায় দলের সকল সহকর্মীকে তিন গ্রুপে বিভক্ত করেন। গ্রুপ অনুযায়ী সকলকে তাঁদের অবস্থান এবং করণীয় সম্পর্কে বিশদভাবে ব্রিফ করেন। কমান্ডার নিজাম, এলাকার অন্য একটি গ্রুপের কমান্ডার মুসাসহ নিজের গ্রুপের সহকর্মী ফরিদ (এই যুদ্ধে শহীদ), কাজল, বেলায়েত, আবু সালেহ, আবুল খায়ের, ফখরুল ইসলাম প্রমুখ ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা এই অপারেশনে অংশ নেন। কমান্ডার নিজামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনের জন্য তাঁদের আশ্রয়কেন্দ্র (বেসক্যাম্প) কবির মিয়ার বাড়ি থেকে আনুমানিক রাত দুইটায় রওয়ানা দিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে অপারেশন স্থানে পৌঁছেন। পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ হাইস্কুলের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, একটি গ্রুপ হাইস্কুলের পশ্চিমে খালের পশ্চিমপাড়ে এবং অন্য গ্রুপটি হাইস্কুলের উত্তরে অবস্থান নেয়। বেস ক্যাম্প থেকে আসার সময় হাইস্কুল থেকে ১০০ গজ দূরে থাকতেই পথিমধ্যে নির্দিষ্ট জায়গায় বিচ্ছিন্নকারী দল বা কার্ট অব পার্টি রাখা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগত অস্ত্র ছাড়াও হাইস্কুলের উত্তরে অবস্থান নেওয়া গ্রুপটির কাছে একটি রকেটলাঞ্চার এবং খালের পাড়ে ও পুকুরের কোণায় অবস্থানরত গ্রুপগুলোতে একটি করে এলএমজি দেয়া হয়। স্কুলঘরটি ইটের দেওয়াল ও টিনের ছাদ থাকায় উত্তরদিক থেকে রকেট লাঞ্চারের গোলা ছুঁড়ে দেয়াল ছিদ্র করে মিলিশিয়া-রাজাকারদের হত্যা করা সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক হবে বলে ধরা হয়। গ্রুপগুলো নিজ স্থানগুলোতে অবস্থান গ্রহণ করার পর কমান্ডার নিজাম দুবার গ্রুপগুলোর অবস্থান পরিদর্শন করেন। প্রথমবার তিনি অস্ত্রগুলোর Setting ঠিক আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করেন এবং দ্বিতীয়বার তিনি সংকেত মোতাবেক ফায়ার ওপেন করার নির্দেশ দেন। তিনি নিজ অবস্থানে এসে সিগন্যাল পিস্তলটির মাধ্যমে ফায়ারের নির্দেশ প্রদান করেন। সব গ্রুপ থেকে ফায়ার চলতে থাকে। কিন্তু দেখা গেল যে, রকেট লঞ্চারের কোনো শব্দ নেই। তাই কামন্ডার নিজাম রকেট লঞ্চারের অবস্থানে গিয়ে দেখেন যে এটির যন্ত্রাংশ কাজ করছে না। ইতোমধে: রাজাকার-মিলিশিয়ারা ভয় পেয়ে চিৎকার করে হাইস্কুলের পূর্বদিকে চলে যায় ! রকেট লঞ্চারটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হাইস্কুলের দেয়াল ছিদ্র করা সম্ভব হবে না এবং অনবরত ফায়ারের কারণে গোলাবারুদ কমে আসার আশঙ্কায় এক পর্যায়ে কমান্ডার নিজামের আদেশে ফায়ার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যেই খালের পাড়ের গ্রুপের সাথে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ অতি উৎসাহী হয়ে “জয়বাংলা” ধ্বনি দিয়ে স্কুলের ভেতরে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হতে থাকেন। এমনসময় ক্রসফায়ারে পড়ে তিনি স্কুলের মাঠে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন এবং পরে মারা যান। কিন্তু এ ব্যাপারটি কমান্ডার নিজামসহ কোনো মুক্তিযোদ্ধারই গোচরীভূত হয়নি। ফায়ার বন্ধ করার পর পশ্চাদপসরণের সিগন্যাল দেয়া হলে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে পেছনে চলে এসে পূর্বনির্ধারিত স্থানে মিলিত হন। দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ নেই। তখন মসজিদে ফজরের আযান দেওয়া হচ্ছে। আকাশ আলোকিত হয়ে আসছে। এ অবস্থায় কমান্ডার নিজাম তাঁর সহযোগী কমান্ডার মুসা এবং মুক্তিযোদ্ধা হারুন ও বেলায়েতকে সঙ্গে নিয়ে ফরিদকে খুঁজে বের করার জন্য ঘটনাস্থলে থেকে অন্যান্য সহযোদ্ধাকে বেসক্যাম্পে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। তাঁরা খবর পান যে, মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ স্কুলের মাঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন। ইতোমধ্যে পালিয়ে যাওয়া রাজাকার-মিলিশিয়ারা Reinforcement করে স্কুলে ফেরত আসে আনুমানিক সকাল ৭টায়। এসে মাঠে স্টেনগানসহ ফরিদের লাশ দেখে আনন্দ-উল্লাস করে। তারা একটি গরুরগাড়ি যোগাড় করে এর পেছনে রশি দিয়ে ফরিদের লাশ বেঁধে রাস্তার ওপর দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে সেখানে থেকে চার মাইল দূরের মিরসরাই থানায় নিয়ে যায়। পরে বিকেলের দিকে জনগণ এসে থানা থেকে লাশ নিয়ে থানাসংলগ্ন পুকুরের পাড়ে ফরিদকে সমাহিত করে। উল্লেখ্য, এই অপারেশনের পর রাজাকার-মিলিশিয়ারা দুর্গাপুর হাইস্কুল থেকে তাদের ক্যাম্প গুটিয়ে নেয়।
[৫৯৪] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত