ভাওয়ালিয়া বাজুর যুদ্ধ, মধুপুর, ময়মনসিংহ
মধুপুর মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আফসার উদ্দিন (মেজর আফসার হিসাবে পরিচিত) তার অনুসারীদের নিয়ে মধুপুর গড়ের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেন। তিনি স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর এই দলটি আফসার বাহিনী বলে পরিচিতি লাভ করে। ভাওয়ালিয়া বাজুর যুদ্ধ ছিল মূলত পাকবাহিনীর অগ্রাভিযান রোধের একটি যুদ্ধ। এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পাকবাহিনী ঘাঁটি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে অবস্থান পরিবর্তন করে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত ভালুকা থানায় ভাওয়ালিয়া বাজু একটি গ্রাম। এই গ্রামটির অবস্থান ভালুকা ও গফরগাঁও থানার মধ্যবর্তী স্থানে। ভালুকা থানা সদর থেকে এর দূরত্ব সোজা পূর্বদিকে ১৫ কিলোমিটার। এই গ্রামের পাশ দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়েছে অপ্রশস্ত একটি নদী। নদীর উপর কোনো সেতু নেই। সকলকে নৌকাতেই পারাপার হতে হয়। ভালুকা থেকে গফর গাঁও যাওয়ার যোগাযোগ সড়কটি আধাকাঁচা আধাপাকা। এটি সামরিক বাহিনীর যানবাহন চলাচলের জন্য উপযোগী নয়। উঁচু-নিচু, নালা-ঝিলে বিলে-খালে সমগ্র এলাকা বিস্তৃত। ময়মনসিংহ থেকে একটি রেললাইন সোজাসুজি গফরগাঁও হয়ে ঢাকার সঙ্গে মিশেছে। এই সময় ঢাকা ময়মনসিংহ সরাসরি কোনো সড়কপথ ছিল না। টাঙ্গাইল হয়ে সড়ক পথে এ যোগাযোগ ছিল। ফলে অবস্থান, যোগাযোগ ও দূরত্বের দিক থেকে ভালুকা ছিল অনেকটা প্রত্যন্ত অঞ্চল। পুরো এলাকাটি অনেকটা জঙ্গলাকীর্ণ। পাকবাহিনীর ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং ৭০ উইং রেঞ্জার্স এর অপারেশনাল এলাকায় ছিল ভালুকা থানার অবস্থান। পার্শ্ববর্তী টাঙ্গাইল এবং রাজেন্দ্রপুরে অবস্থান করছিল পাকবাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট। ভালুকা, প্রত্যন্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনী শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত হয়ে উঠেছে। এই সংবাদ পাওয়ার পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণে তৎপর হয়ে উঠে। কিন্তু অতি সন্নিকটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো ঘাঁটি বা অবস্থান না থাকায় ভালুকা দখলের জন্য তাদেরকে ময়মনসিংহ এবং ঢাকা থেকে সেনা-সমাবেশের প্রয়োজন দেখা দেয়। পাকবাহিনী অতি সন্তর্পণে অথচ যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে ২৪ জুন রাতে ঢাকা এবং ময়মনসিংহ উভয় স্থান থেকে গফরগাঁও থানায় সমবেত হয়। কিন্তু গফরগাঁও থেকে ভালুকা পর্যন্ত রাস্তা যানবাহনের উপযোগী না হওয়ায় ২৫ জুন ভোরে গরু ও মহিষের গাড়িতে ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উঠিয়ে সেনা সদস্যরা গাড়ির দু’পাশে দিয়ে হেঁটে অগ্রসর হতে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় এক কোম্পানী সৈন্য এবং তাদের রসদ ও রেশন সামগ্রী বহন করার জন্য ৪০টি গরুর গাড়ি নিয়োজিত করা হয়। কর্দমাক্ত কাঁচা রাস্তা অতিক্রম করে ভালুকা পর্যন্ত পৌঁছানো ছিল পাকবাহিনীর জন্য ভীষণ কষ্টসাধ্য বিষয়। ২৪ জুন কমান্ডার আফসার উদ্দিনের সহকারী কমান্ডার জনাব আনছার উদ্দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভালুকা থানার দিকে আগমন সংবাদ নিয়ে শান্তিগঞ্জ নামক গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করেন। ২৫ জুন পাকবাহিনীর গতিপথ যাচাই করে আনছার উদ্দিন প্রাথমিকভাবে শান্তিগঞ্জ বাজার এলাকায় পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু পরবর্তীতে বাস্তব অবস্থার কারণে তিনি ভাওয়ালিয়া বাজু ফেরী পার হয়ে নদীর বিপরীত তীরে (পশ্চিম পাশে) পাকবাহিনীকে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেন। নদীর তীর ঘেষে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে তিনি সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করেন। ২৫ জুন সকাল ১০টা নাগাদ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এই দলটি এবং তাদের রসদ বহনকারী গরু ও মহিষের গাড়িসমূহ ভাওয়ালিয়া বাজু ফেরী ঘাটে এসে পৌঁছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর পাকবাহিনী গরু ও মহিষের গাড়িসমূহ ফেরীর মাধ্যমে নদী পার করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই লক্ষ্যে প্রথমে ৬ জন পাকসেনা নদীর পার্শ্ববর্তী উঁচুপাড় থেকে নেমে ফেরীর উপর এসে দাঁড়ায়। তারা নদীর অপর পাড়ে পৌছে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সংকেত দিলে বাকিরা ফেরী পার হয়ে এমন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
[১৬] এ এস এম সামছুল আরেফিন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত