You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.18 | রেলকলোনি গণহত্যা, লালমনিরহাট - সংগ্রামের নোটবুক

রেলকলোনি গণহত্যা

যুদ্ধের শুরুতেই পরিস্থিতি বুঝে যে যার মতন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করতে থাকেন। অন্যান্য এলাকার থেকে লালমনিরহাট একটু ব্যতিক্রম ছিল এর মূল কারণ ছিল লালমনিরহাটে বসবাসকৃত বিপুল সংখ্যক উদুভাষী অবাঙালি। যারা পাকিস্তানিদের অগ্রগামী দল হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। চাকুরি ও ব্যবসা বাণিজ্য করার সুবাদে এরা এলাকার লোকজনদের চিনত। তাঁদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখত। কারা কারা প্রগতিশীল কারা কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, সে সকল খবর তাদের কাছে ছিল। এরাই বেশিরভাগ সময় পাকিস্তানিদের নানা তথ্য ও খবরাখবর দিয়ে সহযোগিতা করত।

যুদ্ধের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে ফুলগাছ গ্রামের প্রয়াত পানাউল্লাহ এর পুত্র শহিদ সোনাউল্লাহ ওরফে চান্দিয়া ভাটিয়া যিনি লালমনিরহাট সদরে থানা পাড়ায় একটি পুকুর পাড়ের বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। পরিস্থিতি অনুধাবনে সীমান্তবর্তী গোরকমন্ডোলে আশ্রয় নেন। তিনি এ বিষয়ে তাঁর পরিবারকেও অবগত করেননি। এ অবস্থায় তাঁর পরিবারের সদস্যরা লালমনিরহাট শহরে অবাঙালি ব্যবসায়ী জনৈক হাফেজ কামরুদ্দিনের তত্ত্বাবধানে রেলওয়ে এর কয়েকটি পরিত্যক্ত কোয়ার্টারে আশ্রিত হিসেবে অবস্থান করছিলেন। সোনাউল্লাহ চান্দিয়া ভাটিয়ার বড় ছেলে আকালু সেখের স্ত্রী ময়না বিবি সে সময় ৫-৬ মাসের গর্ভবতী ছিলেন। এছাড়াও পরিবারের আরও ছিলেন আকালু সেখের ১২ বছর বয়েসি ছেলে আব্বাস আলী, ৯ বছর বয়সে ছোট ছেলে আব্দুল কুদ্দুস, ৬ বছর বয়েসি বড় কন্যা হাজেরা খাতুন এবং ৩ বছর বয়েসি ছোট কন্যা মেহের বানু। এছাড়াও এই পরিবারে আরও ছিলেন সোনাউল্লাহ চান্দিয়া ভাটিয়ার আর এক ছেলে তোরাব আলীর স্ত্রী নুর বানু। তিনিও সে সময়ে সন্তানসম্ভবা ছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল আনুমানিক ২৫-২৬ বছর। সাথে ছিলেন তাঁর ৫ বছর বয়েসি দ্বিতীয় কন্যা সাহেরা খাতুন, ৩ বছর বয়েসি তৃতীয় কন্যা খোদেজা বেগম এবং ১ বছর বয়েসি চতুর্থ কন্যা জয়নব বেগম।

এই বিশাল পরিবারের আরও ছিলেন সোনাউল্লাহ চান্দিয়া ভাটিয়ার কন্যা রহিমা খাতুন বয়স আনুমানিক ৫০ বছর। রহিমা খাতুনের প্রথম পুত্র শহিদ রহিমুদ্দিন মিয়া, বয়স আনুমানিক ২৫ বছর, তিনি বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক ছিলেন। আরও ছিলেন রহিমা খাতুনের ছেলে ১০ বছর বয়েসি কলিমুদ্দিন, ৮ বছর বয়েসি নইমুদ্দিন ও সলিমুদ্দিন, শেষোক্ত দু’জন যমজ ভাই। পরিবারটিতে আরও ছিলেন সোনাউল্লাহ ভাটিয়ার নাত বউ রাবেয়া খাতুন, প্রথম পুত্র ইদ্রিস আলী, বয়স আনুমানিক ৩ বছর এবং ইনসান আলী, বয়স আনুমানিক ১ বচর। বৃহৎ পরিসরের এই পরিবারের উপরোক্ত সদস্যরা হাফেজ কামরুদ্দিনের খুব কাছের লোক হিসেবে তার উপর ভরসা রেখে সেখানে বসবাস করছিলেন। তাঁরা বুঝতে পারেন লালমনিরহাট শহরে বসবাস করাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। সঙ্গত কারণে তাঁরা এপ্রিলের ১৮ তারিখ ফুলগাছ গ্রামে নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তারা পরদিন এপ্রিলের ১৯ তারিখ সকাল থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করে নাস্তা খাবারের আয়োজন করতে থাকেন। সকালের নাস্তা সেরেই তাঁরা লুকিয়ে ছাপিয়ে ফুলগাছে নিজেদের বাড়ির দিকে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু সেটি আর তাঁদের জীবনে হয়ে ওঠেনি। নাস্তা সাড়ার আগেই সকাল দশটার দিকে অপ্রত্যাশিতভাবে বেশ কিছু সংখ্য অবাঙালি ঘাতক তাঁদেরকে কোয়ার্টারের চারদিকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। অসহায় পরিবারটি কিছু বুঝে উঠার আগেই হায়েনারা তাঁদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা বহুবিধ ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে পরিবারের নারী-পুরুষ-শিশুদেরকে। নরপশুরা যাঁকে যে অবস্থায় পেয়েছে তাঁকে বাছ-বিচারবিহীনভাবে সে অবস্থাতেই কুপিয়েছে ও জবাই করে হত্যা করেছে। সেদিন অবাঙালি নরপশুগুলোর হিংস্রতার হাত থেকে রক্ষা পায়নি দুগ্ধপোষ্য শিশুরাও। পরিত্রাণ পায়নি গর্ভবতী নারীরাও। ওই আকস্মিক আক্রমণের শিকার হয়েছে আশপাশে থাকা আরও অনেক বাঙালি পরিবারের সদস্যরা। মুহূর্তেই এলাকাটি পরিণত হয় এক ভয়াল মৃত্যুপুরীতে। সেদিন দিবালোকে এই হত্যাকাণ্ডের শিকার বিপুলসংখ্যক লাশ গায়েব করে দেয় নরপশুরা। লাশগুলোর শেষ ঠিকানা পর্যন্ত জানা সম্ভব হয়নি। সেদিন ঐ নরপশুরা শুধু নিরীহ বাঙালিদের হত্যাই করেনি তারা একইসাথে তাঁদের সাথে থাকা টাকা-পয়সা সোনা-দানাও লুট করেছিল। ঐ হত্যাকাণ্ডে সোনাউল্লাহর পরিবারের নয়জন শহিদ হন যাঁদের মধ্যে নয় জন নিরীহ বাঙালি নারী ও শিশু। শহিদের নাম নিচে উদ্ধৃত করা হলো।

ক্র. নাম পিতা/স্বামীর নাম ঠিকানা
হাজেরা খাতুন আকালু সেখ ফুলগাছ, লালমনিরহাট
ময়না বিবি আকালু সেখ ফুলগাছ, লালমনিরহাট
মেহের বানু আকালু সেখ ফুলগাছ, লালমনিরহাট
নুর বানু স্বামী তোরাব আলী ফুলগাছ, লালমনিরহাট
সাহেরা খাতুন তোরাব আলী ফুলগাছ, লালমনিরহাট
খোদেজা বেগম তোরাব আলী ফুলগাছ, লালমনিরহাট
জয়নব বেগম তোরাব আলী ফুলগাছ, লালমনিরহাট
রহিমা খাতুন তোরাব আলী ফুলগাছ, লালমনিরহাট
রাবেয়া খাতুন সোনাউল্লাহ ভাটিয়ার নাতবউ ফুলগাছ, লালমনিরহাট

সূত্র: উত্তর রণাঙ্গনে সংখ্যালঘু গণহত্যা ও নারী নির্যাতন- এসএম আব্রাহাম