পঞ্চগড় জেলার গণহত্যা ও নির্যাতন
পঞ্চগড় জেলা তখন ঠাকুরগাঁও মহকুমার একটি থানা ছিল। ভৌগোলিকভাবে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা এটি। সীমান্তের ওপারেই মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান। সঙ্গত কারণে মাঝেমধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত পেরিয়ে এসে পাকিস্তানিদের অবস্থানের উপর গেরিলা আক্রমণ করত। যার কারণে পাকিস্তানিরা বেশ সতর্ক থাকত। তাছাড়া এই এলাকায় পাকিস্তানিদের ব্যাপক সমাবেশ ছিল। তারা ভারতীয় আক্রমণ ঠেকাতে বেশ তৎপর ছিল। পাকিস্তানিদের ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ থাকার পরও তেঁতুলিয়া ছিল মুক্তাঞ্চল। পাকিস্তানিরা পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা করে যার মধ্যে মির্জাপুর নয়াদিঘি গণহত্যা, বলরামপুর গণহত্যা, রামনাথপুর রুহিয়া গণহত্যা, মীরগড় গণহত্যা উল্লেখযোগ্য। আটোয়ারী থানায় ডাঙ্গিরহাট পাকিস্তানি ক্যাম্প গণহত্যা ছাড়াও অসংখ্য হত্যা, গণহত্যা সংঘটিত করে পাকিস্তানিরা। যাদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন।
হিন্দু ও নারী নির্যাতনের বিষয়ে বিশিষ্ট গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক তাঁর উত্তরের গণহত্যা ১৯৭১ পুস্তকে পঞ্চগড়ের আটোয়ারী গণহত্যার বিবরণ দেন। তাঁর উদ্ধৃত বর্ণনা থেকে অবগত হওয়া যায় কী পরিমাণ নির্যাতন ও গণহত্যা সেখানে সংঘটিত হয়েছে। নির্যাতন কেন্দ্রে থাকা বেঁচে যাওয়া একজন হলেন জনৈক ইফসুফ মন্টু তাঁর বর্ণনা উদ্ধৃত করা হলো—
‘ইফসুফ মন্টু আটক থাকাকালে দেখেন যে, ২৫০ জনের মতো হিন্দুকে ধরে এনে থানায় আটক করা হয়, থানা হাজতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ওসির কক্ষেও রাখা হয় অনেককে। ইফসুফ মন্টুসহ প্রতিরাতে দুই সারিতে শতাধিক ব্যক্তিকে গোরস্তানের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর এক সারির লোকজনদের দ্বারা খনন করা হয় গর্ত। অন্য সারির লোকদের গুলি করে ফেলে দেয়া হয় সেই গর্তে। গর্ত খননকারী লোকেরা মাটি চাপা দেয় এবং ফিরে আসে তাদের বন্দিশালায়।’
তিনি একই লেখায় নিচের স্তবকে লিখেছেন—‘শান্তি কমিটির নেতৃত্বে রাজাকাররা ভারত থেকে প্রত্যাগত বেশ কিছু হিন্দু শরণার্থীকে হত্যা করে করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে’। এ উদ্ধৃতি দু’টো পরিষ্কার করে কী মাত্রায় নির্যাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হয়েছিল।
পঞ্চগড় এর অমরখানে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পগুলোতে অনেক নারী পাকিস্তানিদের লালসার শিকার হন। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে দখল অবসানে চূড়ান্ত লড়াইয়ে অমরখান হানাদার মুক্ত করলে ক্যাম্পগুলো থেকে অনেক বিবস্ত্র নারীকে উদ্ধার করেন। সেখানে তারা আটক আটক থাকাবস্থায় বহুদিন ধরে নিয়মিত নির্যাতন ও পশুদের ভোগ বিলাসের শিকার ছিলেন।
অমরখান ছাড়াও পঞ্চগড় জেলার মীরগড়, মধুপাড়া, বিষমনি, বদলুপাড়া, কায়েতপাড়া, তালমা, গরুহাটি, খোলাপাড়া, জাবরিদুয়ার, জালাসিছাড়াও আটোয়ারী, বোদা থানাতেও শত শত নারী পাকিস্তানিদের ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতিতদের ক্ষুদ্র একটি অংশই পুনর্বাসিত হন। অনেকেই আত্মহত্যা করেন, অনেকেই আবার মৃত্যুও বরণ করেছেন।
নিম্নে হিন্দু পরিবারের সদস্য যাদের মধ্যে কয়েকজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের শহিদ সদস্য ও নির্যাতিত নারীর নাম যাঁদের নাম পাওয়া গেছে তা সংযুক্ত করা হলো—
ক্র. | নাম | পিতা/স্বামীর নাম | ঠিকানা |
১ | শহিদ যতীন কম্পাউন্ডার | অজ্ঞাত | বোদা, পঞ্চগড় |
২ | শহিদ লখিয়া | অজ্ঞাত | পঞ্চগড় |
৩ | শহিদ সালেহা বেগম | অজ্ঞাত | পঞ্চগড় |
৪ | শহিদ বালেহা বেগম | স্বামী ছনমুদ্দিন | রাধানগর, আটোয়ারী |
৫ | শহিদ কালো বিবি | অজ্ঞাত | তবেয়া, আটোয়ারী |
৬ | শহিদ দর্শন চন্দ্র বর্মণ | অজ্ঞাত | মির্জাপুর, আটোয়ারী |
৭ | শহিদ সুবোধ চন্দ্র | অজ্ঞাত | সুন্দরদিঘি, দেবিগঞ্জ |
৮ | শহিদ শ্যামাকান্ত বর্মণ | টেপসিং বর্মণ | পামুলি, দেবিগঞ্জ |
৯ | শহিদ নিশিকান্ত | অজ্ঞাত | পামুলি, দেবিগঞ্জ |
১০ | শহিদ কালটং বর্মণ | অজ্ঞাত | পামুলি, দেবিগঞ্জ |
১১ | শহিদ চপাই মোহন বর্মণ | হরনারায়ণ বর্মণ | পামুলি, দেবিগঞ্জ |
১২ | শহিদ প্রফুল্ল চন্দ্র বর্মণ | পত্র মোহন বর্মণ | পামুলি, দেবিগঞ্জ |
(পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়)
শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম
ক্র. | নাম | পিতা/স্বামীর নাম | ঠিকানা |
১ | শহিদ মুক্তিযোদ্ধা নৃপেন্দ্রনাথ বর্মণ | যগেন্দ্রনাথ বর্মণ | হরিনিমাই পাড়া, পাঁচপীর, পঞ্চগড় |
২ | শহিদ মুক্তিযোদ্ধা প্রেমহরি বর্মণ | প্রিয়নাথ বর্মণ | গোবিন্দগুরু, সাকোয়া |
৩ | শহিদ মুক্তিযোদ্ধা স্বপন কুমার বকসী | নগেন্দ্রনাথ বকসী | বকসীপাড়া, সাকোয়া |
৪ | শহিদ মুক্তিযোদ্ধা কেশব চন্দ্র রায় | শ্রী ভগরাম | বনগ্রাম কালিয়াগঞ্জ, বোদা |
(পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়)
সূত্র: উত্তর রণাঙ্গনে সংখ্যালঘু গণহত্যা ও নারী নির্যাতন– এসএম আব্রাহাম