You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঠাকুরগাঁও জেলা হত্যা ও নির্যাতন

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক বক্তব্যের পর থেকে ঠাকুরগাঁও শহর একাত্তরে অগ্নিগর্ভ রূপ লাভ করে। উত্তাল মার্চে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন রাজপথে নেমে আসত। বিক্ষুব্ধ জনতার উত্তালতরঙ্গে যুক্ত হতে বাদ পড়েনি স্কুলের ছাত্ররাও। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলে ঠাকুরগাঁও এর বীর জনতা নেমে পড়েন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে। তাঁদের সাথে যুক্ত হন ঠাকুরগাঁও এর আনসার ও ইপিআর সদস্যরা। সংগঠিত প্রতিরোধকে পণ্ড করতে পাকিস্তানিরা সচেষ্ট ছিল। তারা ২৮ মার্চ ১৪ বছরের কিশোর নরেশ চৌহানকে নিজ বাড়ির বেড়ায় জয়বাংলা শ্লোগান লেখা অপরাধে টার্গেট স্যুট করে হত্যা করে।
প্রতিরোধের প্রতিশোধে ঠাকুরগাঁও জেলায় একাত্তরে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করে পাকিস্তানি বাহিন। ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী প্রথম ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রবেশ করে। তারা সৈয়দপুর থেকে রওনা দিয়ে ঠাকুরগাঁও অভিমুখে যাত্রাপথে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে। তারা পথের দুই ধারের ঘর-বাড়িতে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করে। পাকিস্তানি বাহিনী ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশের পরদিন জেলা শহরের সালন্দর গ্রামে প্রবেশ করে গ্রামটিকে ঘিরে রাখে। তাদের কাছে খবর ছিল সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারীদের শক্ত অবস্থানের কথা। তারা সেখানে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করে। সেদিন সেখানে তারা সাত জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে।
দেশিয়া পাড়াতে ১৫ এপ্রিল গণহত্যার শিকার হন ৬০/৬৫ জন নিরীহ বাঙালি। এই গণহত্যার শিকার ভোমরাদহ ও আশপাশের হিন্দু পাড়াগুলোর সদস্যরা। পাকিস্তানি বাহিনী ১৭ এপ্রিল পীরগঞ্জ প্রবেশ করে ভাতারমারী ফার্মের পার্শ্ববর্তী এলাকায় গণহত্যা করে। সেখানে তারা বেশ কয়েকজন বাঙালিকে হত্যা করে।
এপ্রিল মাসেই গড়েয়া-কিসমত তেরয়ারিগাঁও গ্রামে সমরেন্দ্রনাথ, মতিলালকে হত্যা করে পাকসেনারা।
ভারতমুখী শরণার্থীদের পথরোধ করে পাকিস্তানি বাহিনী ২৩ এপ্রিল ১৯৭১ সদর থানার জাটিভাঙ্গায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিন সহস্রাধিক নিরীহ বাঙালি। যাতে করে বিধবাই হন ৩৫০ জন ‍দুর্ভাগা বাঙালি রমণী। চকহলদি গ্রামে একরাতেই ২০ রমণী বিধবা হন। জাটিভাঙ্গা গণহত্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হন জগন্নাথপুর, বাসুদেবপুর, চকহলদি, সিঙ্গিয়া, চণ্ডিটপুর, আলমপুর, গৌরীপুর, মিলনপুর, শুকানপুকুরী, ঢাবঢুব ও খোমারভোপলা গ্রামের মানুষ।
পাকিস্তানিরা এপ্রিলেই বালিয়াডাঙ্গি থানায় প্রখ্যাত রাজনীতিক দবিরুল ইসলামের পিতাসহ ২৫ জনকে পাকিস্তানিরা ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে তাঁদের লাশ পাশে তিরনই নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
স্বাধীনতা বিরোধীদের সহযোগিতায় হরিপুর মসজিদের ইমামসহ শতাধিক বাঙালিকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। তাঁদেরকে কীভাবে কোথায় হত্যা করা হয়েছে সে খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।
সোবহান পাড়ায় গণহত্যা করে পাকিস্তানিরা। তারা একটি গণকবরে অনেককে মাটিচাপা দেয়। যেখানে জীতেন্দ্রনাথ সিংসসহ অনেককেই মাটি চাপা দেয় পাকিস্তানিরা। ফারাবাড়িতে গণহত্যা করে ১৫ মে ১৯৭১ তারিখে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা শেখ শহর আলীসহ ১৮ জন বাঙালিকে হত্যা করে আব্দুর রশিদ কলেজের পাশে একটি কুয়ায় ফেলে দেয়।
এ জেলার অন্য গণহত্যাগুলোর মধ্যে টাঙ্গন ব্রিজ গণহত্যা সংঘটিত হয় ২৪ মে ১৯৭১।
৮ আগস্ট রুহিয়া গণহত্যা সংঘটিত করে খান সেনারা। সমগ্র যুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনী পীরগঞ্জ থানার তেঁতুলতলা ফার্মে প্রায় তিন হাজার নিরীহ বাঙালিকে ধরে এনে হত্যা করে। তাঁদের হত্যার পর জগথা রাইসমিল ও সরকারি কলেজের পাশে মাটি চাপা দেয়।
কামারপুর গণহত্যার শিকার হন ৬০০/৭০০ নিরীহ বাঙালি। কামারডাঙ্গায় ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। তারা প্রতিদিন নানাস্থান থেকে স্থানীয় ও ভারতগামী শরণার্থীদের ধরে এনে হত্যার পর কামারপুকুরে ফেলে আসত। একের পর এক লাশ ফেলে যাওয়ায় কামারপুকুরটি একটি গণকবর ও বধ্যভূমিতে রূপান্তরিত হয়।
এতদ্ব্যতিত পাকিস্তানিরা পীরগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে অনেককে হত্যা করে। হত্যার পর সেখানে অনেককে মাটি চাপা দেয়।
বামুনিয়ায় গণহত্যার পর অনেককেই বামুনিয়ায় মাটি চাপা দেয়। সেখানে চিনিরাম সিংহসহ অনেকেরই লাশ সেখানে অযত্ন অবহেলায় পড়ে কুকুর শৃগালের আহারে পরিণত হয়। এছাড়াও পাকিস্তানিরা ওয়াবদা ওয়ার্কসপ, পায়েন্দানা চৌধুরী পাড়া, ঠাকুরগাঁও সুগারমিল গণহত্যা করে।
নিম্নে ঠাকুরগাঁও জেলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শহিদ সদস্য যাঁরা গণহত্যার শিকার হয়েছেন। এ পর্যন্ত যাঁদের নাম সংগ্রহ করা গেছে তাঁরা হলেন—

বালিয়াডাঙ্গী ও সদর থানার শহিদ হিন্দু সম্প্রদায়ের শহিদ সদস্যগণ 

ক্র. শহিদের নাম পিতা/স্বামীর নাম ঠিকানা
শহিদ সমল বাবু অজ্ঞাত বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও
শহিদ ভূবন মণ্ডল সিংহ (চৌকিদার) অজ্ঞাত বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও
শহিদ সমরেন্দ্র রায় অজ্ঞাত বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও
শহিদ আশুতোষ চৌধুরী অজ্ঞাত ঠাকুরগাঁও সদর, ঠাকুরগাঁও
শহিদ নরেশ চৌহান অজ্ঞাত ঠাকুরগাঁও সদর, ঠাকুরগাঁও
শহিদ ব্রজমোহন বর্মণ গদাপঘর বর্মণ গোরকই, নেকমরদ, ঠাকুরগাঁও
শহি সিরেন্দ্রনাথ দেবাচরণ আলিবাড়ি, কাশিপুর, ঠাকুরগাঁও
শহিদ যোতিন্দ্রনাথ সিংহ সাবু রাম সিংহ বানাগাঁও, ধনতলা, ঠাকুরগাঁও

সূত্র: উত্তর রণাঙ্গনে সংখ্যালঘু গণহত্যা ও নারী নির্যাতন– এসএম আব্রাহাম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!