গণহত্যা নীলফামারী
উত্তরের জেলাগুলোর মধ্যে নীলফামারী জেলায় পাকিস্তানিদের ভয়াবহতম নৃশংসতা ছিল। সৈয়দপুর কার্যতঃ মিনি পাকিস্তান ছিল একাত্তর। বিপুল সংখ্যক অবাঙালিদের বসবাস পাকিস্তানিদের জন্য বাড়তি শক্তি ছিল। ’৭০-এর নির্বাচনের পর থেকে এখানে হরহামেশাই খুনখারাবি করতো উদুভার্ষী অবাঙালিরা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর সে মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। মার্চের পর থেকে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী ও অবাঙালিরা মিলে। তারা শুধু সৈয়দপুরে নয় সমগ্র নীলফামারী জেলাতে গণহত্যা সংঘটিত করে। যাঁরা শহিদ হয়েছেন তাঁদের সকলের নাম ঠিকানা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এখনো অনেক গণকবর ও বধ্যভূমি অনাবিষ্কৃত রয়েছে। নীলফামারী জেলায় এ যাবতকালে যেসকল বধ্যভূমির তথ্য পাওয়া যায় সেগুলো হচ্ছে নীলফামারী সরকারি কলেজ বধ্যভূমি ও সরকারি কলেজ গণকবর। কুন্দপুকুর সুটিপাড়া বধ্যভূমি। দারোয়ানি টেক্সটাইল মিলস্ বধ্যভূমি। দারোয়ানি টেক্সটাইল বাঁশঝাড় গণকবর। বোরাগাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বধ্যভূমি। ডোমার বনবিভাগ উঁচুঢিবি শালকি নদীবিধৌত বধ্যভূমি। গোমনাতি চৌধুরী পাড়া বধ্যভূমি। চিলাহাটী ফুলবাড়ী খানকা শরিফ বধ্যভূমি। চিলাহাটী মার্চেন্ট উচ্চ বিদ্যালয় বধ্যভূমি। জোরাবাড়ি সিজনগঞ্জ বালাবাড়ি বধ্যভূমি। ডিমলা শুটিবাড়ি বধ্যভূমি। বামুনিয়া নদীর পাড় বধ্যভূমি। আসাদগঞ্জ বধ্যভূমি। সিংগাহারা নদী বধ্যভূমি। জলঢাকা কালিগঞ্জ বধ্যভূমি। সৈয়দপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসা বধ্যভূমি, সৈয়দপুর হাইস্কুল বধ্যভূমি, সৈয়দ টেকনিক্যাল স্কুল বধ্যভূমি, চিকলী ব্রিজ বধ্যভূমি, সমলা বা সরমা নদী বধ্যভূমি। নয়াটোলা কুপ বধ্যভূমি, কয়া মিস্ত্রি পাড়া কুপ বধ্যভূমি, খরচাখাতা বধ্যভূমি, দহলা পট্টি বধ্যভূমি, বাশবাড়ি সেফটি ট্যাংক, বিমানবন্দর সংলগ্ন কুপ, জোড়াতলা বধ্যভূমি, চাটিয়া প্রেস গণকবর, বয়লার শপ, পালপাড়া শ্মশান বধ্যভূমিগুলোতে হাজার হাজার মানুষ গণহত্যার শিকার হন।
নীলফামারী শহর পাকিস্তানিদের দখলে যায় একাত্তরের সাতাশ এপ্রিল। সৈয়দপুর ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট। পাকিস্তানিরা সৈয়দপুরে দারুল উলুম মাদ্রাসা এবং সৈয়দপুর উচ্চ বিদ্যালয়কে বন্দিশালা হিসেবে গড়ে তোলে। প্রকৌশলী ফজলুর রহমান ছিলেন সৈয়দপুরে পাক হানাদার পাক বাহিনীর নর হত্যার শিকার বাঙালি অফিসার। তাঁর ছোট ভাই রংপুর মেডিকেলের ছাত্র রফিকুল ইসলাম সৈয়দপুরে একই হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। পরিবারের সদস্যরা শহিদ হবার পর ফজলুর রহমানের স্ত্রী সুরাইয়া বেগম পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হন। তিনি দেখতে পান বন্দিশালায় ৬০০/৭০০ মহিলাকে আটকে রাখে। সেখানকার প্রত্যেক মহিলাই পাকিস্তানিদের বর্বর নির্যাতনের শিকার ছিলেন।
১৩ জুন ভোর পাঁচটায় সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের একশ পঞ্চাশজন বন্দিকেসহ অপরাপর বন্দিদের সাথে ভারতে পৌঁছে দেয়ার নাম করে রেলস্টেশনে নিয়ে যায়। লোক পাঠিয়ে বন্দিদের প্রত্যেকের পরিবারের মহিলা ও শিশু সন্তানদেরকেও স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। মহিলারা সঞ্চিত টাকা, সোনার গয়না প্রভৃতি অস্থাবর সম্পদ নিয়ে আসেন। তাঁরা ভেরেছিলেন ভারতে যখন যেতেই হবে তখন টাকা পয়সা সাথে করে নিয়ে যাওয়াই ভালো। আসলে পুরো ব্যাপারটাই ছিল পাকিস্তানিদের একটা নীলনকশা যা হতভাগ্যরা বুঝতে পারেনি। ট্রেনের পেছনের দুটো বগিতে মহিলা ও শিশুদেরকে এবং সামনের দুটো পুরুষদেরকে উঠানো হয়। ট্রেনটি দুই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের কাছকাছি একটি কালভার্টে গিয়ে থেকে যায়। এরপর ডাকাত ইদ্রিস নামে পাকিস্তানিদের দোসর প্রথম বগি থেকে একজন একজন করে নামিয়ে তলোয়ার দিয়ে তাঁদের মাথা কেটে লাথি মেরে কালভার্টের নিচে ফেলতে থাকে। অনেকে ট্রেনের জানালা ভেঙে পালিয়ে বাঁচলেও বাকিদের জবাই করে হত্যা করে পাকসেনা ও তাদের অবাঙালি সহযোগিরা।
সেদিনের পাকিস্তানিদের আক্রমণের শিকার মহিলা এবং শিশুদের একজনও পালাতে পারেনি। প্রত্যেক মহিলাকে অবর্ণনীয় কষ্ট ও যন্ত্রণা দিয়ে ধর্ষণ করার পর তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। ড. এমএ হাসান তার যুদ্ধ ও নারী গ্রন্থের ২৬৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন ‘ধোপারা যেভাবে কাপড় কাচে সেভাবে রেললাইনের উপর মাথা আছড়ে কখনো দু’পা ধরে টান দিয়ে ছিঁড়ে দু-টুকরা করে হত্যা করে শিশুদেরকে’। স্বাধীনতা লাভের অনেকদিন পরও সেখানে মহিলাদের কাপড়, ক্লিপ, চুল, চুলের খোপা ইত্যাদি পড়েছিল। সেদিন পাকিস্তানি ও তাদের সহযোগিদের হত্যার শিকার হন প্রায় আড়াইশ নারী ও শিশু।
একাত্তরের চৌদ্দ, পনেরো ও ষোলই ডিসেম্বর রংপুর উপশহর, সাতগড়া, ধাপ এলাকা, সাগর পাড়া রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণে ও কাউনিয়া রেল স্টেশনের বাঙ্কার এবং লালমনিরহাট শ্মশান, ট্রেনের মাল গাড়ির বগি, তিস্তা নদী ও গঙ্গাচড়া থানার উত্তরে নদীর বালুচরে চারশত তের জন বীরাঙ্গনার ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়েছিল।
সূত্র: উত্তর রণাঙ্গনে সংখ্যালঘু গণহত্যা ও নারী নির্যাতন- এসএম আব্রাহাম