কাঁঠালবাড়ী গণহত্যা ও বধ্যভূমি
কুড়িগ্রাম সদরে কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নে প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাছাড়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ এক্সেন আলীর বাড়িও এখানেই। তাঁর নেতৃত্বে কাঁঠালবাড়ীতে ব্যাপক গণসংগ্রাম হয়। আবার কাঁঠালবাড়ীর চেয়ারম্যান ও তার পুত্র আজাদ বক্ত ও সৈয়দ বক্ত দু’জনই খাঁটি পাকিস্তানপন্থী। তাদের নেতৃত্বে একাত্তরে পিস কমিটি গঠিত হয়। বাপ বেটা দু’জনই পাকিস্তানিদের পেয়ারের বান্দা ছিলেন। একাত্তরের ঘোর দুর্দিনে যখন শহরের মানুষজন কুড়িগ্রাম ত্যাগ করে ভারত কিংবা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছিল। তখন তারা বাপবেটা পরিবার পরিজন নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় কুড়িগ্রাম শহরে আরাম আয়েশে জীবন কাটান। কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র আব্দুস সালাম যুদ্ধের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যাচে সেনাবাহিনীর কমিশন লাভ করেন। তিনিসহ সাহেবগঞ্জ সাবসেক্টরের যোদ্ধা আব্দুল মজিদ কমান্ডার, নজরুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন, নূরুল আমিন সরকার, নুরুল হক প্রমূখ তাদের লোকজন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে মাঝে মধ্যেই রাজাকার ও পাকিস্তানিদের তটস্থ করে তোলেন। কাঁঠালবাড়ীর সীমান্ত ঘেঁষে ছিনাইয়ের ব্রাহ্মণ পাড়ায় মুজিব বাহিনীর লিডার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শুভ্রাংশু চক্রবর্তীর বাড়ি। কাঁঠালবাড়ী ছিল সেদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। তাছাড়া পাশেই ধরলা নদীরদ ওপার থেকে ফুলবাড়ী মুক্তাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে হানা দিত। এ সকল কারণে কাঁঠালবাড়ীর প্রতি পাকিস্তানিদের ক্ষোভ ছিল। তাদের ক্ষোভ চরিতার্থ করবার জন্য পিস কমিটির চেয়ারম্যান পনির উদ্দিন আহমেদের পুত্র তাজুল ইসলাম চৌধুরীর ইন্ধন ও নেতৃত্বে সৈয়দ আজাদ বক্ত আলীর ও সৈয়দ বক্ত আলীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা নিধনের অংশ হিসেবে ৯ জুন কাঁঠালবাড়ীতে নৃশংসতা চালায়। ওইদিন পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্য তাদের বাড়িঘরে ব্যাপক তল্লাশী চালায়। পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন করে। তারা কাঁঠালবাড়ী বাজার, শিবরাম, সর্দারপাড়া, সন্ন্যাসী, ফকিরপাড়া, প্রামানিকটারী, খামার গ্রামসহ কয়েকটি গ্রামের প্রায় পাঁচশত দোকান ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। তারা ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে হতভাগ্য শহিদদের দুই-একজনের লাশ পারিবারিক গোরস্তানে সমাহিত করা হলেও আরও অনেক শহিদের মৃতদেহ সন্ন্যাসীর খালসহ কাঁঠালবাড়ীর বিভিন্ন খাল বিলে পড়ে থাকতে দেখা যায় যেগুলো পঁচে গলে বাংলার মাটির সাথে মিশে যায়। কোনো কোনোটা পানির স্রোতে বড়পুল হয়ে গর্ভবিলে ভেসে গেছে। শুধু ৯ জুনই পাকিস্তানি বাহিনী কাঁঠালবাড়ীতে ঢুকেছিল তা নয় এর আগে ও পরে বহুবার ঢুকেছিল। ওই অপারেশনগুলোতে পাকিস্তানি সৈন্যরা যতবার কাঁঠালবাড়ী ঢুকেছে ততবারই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। পাকিস্তানের দালাল মতিয়ার রহমান (কুড়িগ্রাম পল্লী বিদ্যুতের সামনে বাড়ি) সে সব সময় পাকিস্তানিদের সঙ্গে ছিল। যাঁদের হত্যা করেছে পাকিস্তানিরা তাঁদের লাশ উন্মুক্তস্থানে ফেলে রেখে যেত। সে সকল শহিদদের দাফন করার সুযোগও ছিল না ফলে সমগ্র কাঁঠালবাড়ীর মাটিকে বধ্যভূমি বললে অত্যুক্তি হবে না।
কাঁঠালবাড়ী গণহত্যার শিকার যে দু’জন সংখ্যালঘুর নাম পাওয়া গেছে তাঁরা হলেন—
ক্র. | শহিদের নাম | পিতা/স্বামী | ঠিকানা |
১ | শহিদ বসন্ত কুমার | অজ্ঞাত | তালুক কালোয়া, কাঁঠালবাড়ী |
২ | শহিদ টেংরি বেওয়া | অজ্ঞাত | সর্দার পাড়া, কাঁঠালবাড়ী |
(পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়)
সূত্র: উত্তর রণাঙ্গনে সংখ্যালঘু গণহত্যা ও নারী নির্যাতন– এসএম আব্রাহাম