You dont have javascript enabled! Please enable it! চিলমারী ঘাট (বন্দর) ও চিলমারী রেলস্টেশন বধ্যভূমি ও গণকবর, কুড়িগ্রাম - সংগ্রামের নোটবুক

চিলমারী ঘাট (বন্দর) ও চিলমারী রেলস্টেশন বধ্যভূমি ও গণকবর

একাত্তরে চিলমারী রেলস্টেশন ও চিলমারী নদীবন্দর কাছাকাছি ছিল। কুড়িগ্রাম জেলার বৃহত্তর নদীবন্দর হচ্ছে চিলমারী। এই নদীবন্দরকে ঘিরে পাকিস্তানিদের শক্ত অবস্থান ছিল সেখানে। চিলমারী নদীবন্দরের বড় বড় পাট গুদামগুলোতে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে ভারত ও পূর্বদিকে রৌমারী, দক্ষিণে গাইবান্ধা, বাহাদুরাবাদ ঘাট এর সাথে যোগাযোগের মূল পথই ছিল চিলমারী। এই পথ দিয়ে হাজার বাঙালি চলাচল করত। পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের চোখে যাত্রীবাহী নৌকা পড়লেই স্পীডবোটে করে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁদের সে নৌকাগুলো আটক করে যাত্রীদের মালামাল টাকা-পয়সা, সোনাদানা লুট করত। যাত্রীদের মধ্যে যুবক যুবতীদের ধরে নিয়ে চিলমারী ঘাটে আসত। সেখানে তাঁদের নানা রকম জিজ্ঞাসা করত। যুবতীদের আটকে রেখে নিয়মিত ধর্ষণ করত। এখানে শত শত যুবক যুবতীকে হত্যা করে পাশেই বালুতে পুঁতে রাখত। অনেক লাশ কুকুর শৃগাল ও শকুনে খেয়েছে। হতভাগ্য অনেক নিরীহ বাঙালির লাশ ব্রহ্মপুত্র নদে ভাসিয়ে দিত তারা। এভাবেই চিলমারী ঘাট বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। অন্যদিকে রংপুর-কুড়িগ্রাম থেকে ট্রেনে করে বন্দি করে আনা বাঙালিদের চিলমারী রেলস্টেশনে এনে হত্যার পর স্টেশনের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ক্যানেলে ও রেললাইনের পাশের ডোবায় ফেলে দিত। যে ডোবা ও ক্যানেলের সাথে ব্রহ্মপুত্রের সংযোগ ছিল। যা নদীবন্দরের পাশ দিয়েই প্রবাহিত ছিল।

১৭ অক্টোবর ১৯৭১ ঐতিহাসিক চিলমারী যুদ্ধে রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য বালাবাড়ি রেলস্টেশনে নিহত হয়। পাকিস্তানি দালাল শামসুল হক পঞ্চু মিয়া ও অলি মোহাম্মদকে মুক্তিযোদ্ধারা রৌমারী ধরে নিয়ে যায়। সেখানে পরদিন তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। সেই ঘটনার পর পঞ্চু রাজাকারের ছোট ভাই রাজাকার আজিজুল হক ভাটু সমগ্র চিলমারী থানায় বহু হত্যাকাণ্ড ঘটায়। তার নেতৃত্বে চিলামারী ঘাটের পাশেই রমনা গুরাতি পাড়ার শ্রী মনভোলা পিতা-হলোধর, খৈমুদ্দিন পিতা-মুঈনুদ্দিন, মফিজ উদ্দিন পিতা-ভেংরা শেখ, ফুল মিয়া পিতা-মোঃ আলী, আবু জেয়াদ পিতা-মেন্দল, আব্দুস ছাত্তার পিতা-খুকু শেখ, টেপু শেখ পিতা-নাজির উদ্দিন, রফিয়াল পিতা-নেছার, মেহের আলী পিতা-দলে সরকার, গেল্লা শেখ ওরফে গেল্লা গাড়িয়াল ও আজগার আলী উভয় পিতা-ইউছুব পানাতি, ছলি শেখ পিতা-অজ্ঞাত, মারুয়া ফকির পিতা-অজ্ঞাত, মহিজুদ্দিন পিতা-মইনুদ্দিন, নছিবুল্ল্যাহ দেওয়ানী পিতা-রহমুতুল্ল্যাহকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। চিলমারী যুদ্ধের দিন চাকলিরপাড় গ্রামের আবুল হোসেন, তাঁর ৫ বছরের ছোট মেয়ে আফিয়া খাতুন, পচু ডাকাতের মা এবং রমনা পানাতি পাড়ার আজিজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী লতিফন নেছা শহিদ হন। চিলমারী যুদ্ধের দু’দিন পর বা রোজার তিনদিন পূর্বে খান সেনারা বৈলবৈন্দিয়ার খাতার মহিজউদ্দিন ব্যাপারীর পুত্র মশিউর রহমান সদা ব্যাপারী ও সারওয়ার হোসেনকে এবং নূর হোসেন ব্যাপারীর পুত্র নুরুদ্দিন ও নূর ইসলাম লেচুকে হত্যা করে। এ ছাড়াও নয়ান হাজীর গ্রাম (খলখড়িয়া) রমনার আহাব্বর হোসেন পিতা-পানাউল্লা সেখ, বালাজান খরখড়িয়ার আব্দুল লতিফ পিতা-নজমুদ্দিন, দুলাল পিতা-আব্দুল করিম, সাহের বানু (সদ্য বিবাহিতা) পিতা-মিয়াজ উদ্দিন, চিলমারী ঝাউবাড়ী গ্রামের (পরে বালাজান পাড়া) আবুল কাশেম ও নিরাশা উভয় পিতা-জহর আলী, মধ্যপাড়া রমনার দেলোয়ার হোসেন পিতা-গেন্দলা মামুদ, চাকলিরপাড়ে আইজলকে হত্যা করেছিল। উল্লেখিত শহিদগনের অনেকের লাশও চিলমারী ঘাট বধ্যভূমিতে পড়েছিল। হতভাগ্যদের অনেকের লাশ কুকুর শিয়াল শকুনের খাদ্য হয়েছিল। কারও কারও লাশ ব্রহ্মপুত্রের প্রবল স্রোতে ভেসে যায়। সে সময়ের চিলমারী ঘাট বর্তমান চিলমারী ঘাট থেকে বেশ দক্ষিণে বর্তমান ব্রহ্মপুত্রের কয়েক কিলোমিটার গভীরে অবস্থিত ছিল। উক্ত শহিদগণের মধ্যে নিম্নোক্তগণ নারী শহিদ ছিলেন।

ক্র. শহিদের নাম পিতা/স্বামী ঠিকানা
শহিদ লতিফুন নেছা শহিদ আজিজুর রহমান রমনা পানাতি পাড়া, চিলমারী
শহিদ আফিয়া খাতুন (৫ বছর) আবুল হোসেন চাকলির পাড়, চিলমারী
শহিদ মাতা (পচু ডাকাতের মা) অজ্ঞাত চাকলির পাড়, চিলমারী
শহিদ সাহের বানু মিয়াজ উদ্দিন বালাজান পাড়া খরখড়িয়া, চিলমারী

(পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়)

সূত্র: উত্তর রণাঙ্গনে সংখ্যালঘু গণহত্যা ও নারী নির্যাতন- এসএম আব্রাহাম