You dont have javascript enabled! Please enable it!

জেল গণহত্যা কুড়িগ্রাম ও বধ্যভূমি

২৮ মার্চ থেকে তিস্তা ব্রিজে বাঙালির প্রবল প্রতিরোধের কারণে ৫০ কিলোমিটার দূরে উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সেনানিবাস থাকার পরও পাকিস্তান আর্মি ৭ এপ্রিল পর্যন্ত কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করতে পারেনি। তারা ব্রিজ অতিক্রমের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তিস্তার প্রতিরোধে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা মেজর এজাজ সহ ১৫ জন নিহত হয়েছিল। পরে কৌশল বদল করে ভিন্ন পথে তারা হারাগাছ-খুনিয়াগাছ এলাকা দিয়ে কুড়িগ্রাম মহকুমায় প্রবেশ করে, আকাশপথে নেমে লালমনিরহাট বিমান বন্দর ও রেল জংশন দখলে নেয়। এরপর তারা উপড়ে ফেলা রেললাইন পুনঃস্থাপন করে ৭ এপ্রিল প্রথমবারের মতো কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। তারা শহরে ঢুকেই কুড়িগ্রাম জেলখানার সিপাহিদের ধরে নিয়ে আসে বর্তমান কুড়িগ্রাম সার্কিট হাউজের পেছনের সি এন্ড বি রেস্ট হাউজে। সেখানে পাশের সড়কে তাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে গণহত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। এতে শহিদ হন জেল ইনচার্জ হেদায়েতুল্লাহ, সিপাহি জহির উদ্দিন, সিপাহি লাল মোহাম্মদ, সিপাহি আনসার আলী, সিপাহি সাজ্জাদ হোসেন ও সিপাহি ফখরুদ্দিন। সিপাহি আব্দুল জলিল গুলিবিদ্ধ হয়ে মরার মতো ভান করে থাকায় বেঁচে যান।

৭ এপ্রিল জেলখানায় গণহত্যার প্রতিবাদে জেলাখানার জামাদারকে আনসার কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্রনেতা এস.এম. হারুন অর রশীদ লাল, মতিউল ইসলাম চৌধুরী (নয়া), এস.এম. আজহারুল ইসলাম রাজা, রজব আলী, এস.এম. ওমর ফারুক প্রমুখ আটক করেন। সন্ধ্যা বেলা তাকে নাগদহ বিলে নিয়ে গিয়ে মহিউদ্দিন আহমেদের বন্দুক দিয়ে হারুন অর রশীদ লাল ও মতিউল ইসলাম চৌধুরী গুলি করে হত্যা করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ওইদিন বিপুল সংখ্যক গোলাবর্ষণ করে যেমন গণহত্যা করেছিল তেমনি যাওয়া আসার পথে রেল লাইনের আশপাশের সকল ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। অপারেশন শেষে পাকিস্তানি বাহিনী রংপুরের দিকে ফিরে গেলে সন্ধ্যায় আনসার বাহিনীর মহকুমা প্রধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহকুমা সংগ্রাম কমিটির সদস্য আনসার কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ তাঁর পুত্র ছাত্র ইউনিয়ন জেলা সাধারণ সম্পাদক এস.এম. হারুন আর রশীদ লাল, ভাগ্নে মতিউল ইসলাম চৌধুরী (নয়া) লাশগুলো বহন করে জেলখানায় নিয়ে আসেন। তাঁর জেষ্ঠ্যপুত্র এস.এম. আজহারুল ইসলাম রাজা ওই সকল জেল সিপাহিদের লাশের জানাযা পড়িয়েছিলেন। মৃতদেহগুলো নিয়ে এসে কুড়িগ্রাম জেলাখানার বর্হিবাউন্ডারির পূর্বদিকের ফাঁকা জমিতে কবর দেন তাঁরা এবং জেল ইনচার্জ হেদায়েতুল্লাহকে নিকটস্থ ব্যাপারী পাড়ায় সমাহিত করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী কুড়িগ্রামে স্থায়ীভাবে অবস্থান নিলে জেলাখানাটি কার্যতঃ তাদের কসাইখানায় পরিণত হয়। এখানে যেমন পাবলিকের গরু-ছাগল নিয়ে এসে মজুদ করত। তেমনি অনেক বাঙালিকে সেখানে আটক করে নির্যাতনের পর হত্যা করে সেখানেই মাটি চাপা দিত বা ফেলে রাখত। নিকটস্থ সি এন্ড বি রেস্ট হাউজের মাঠে সেনা অফিসারদের সামনে জনৈক অবাঙালি নিয়ামত কসাই বহু বাঙালিকে জবাই করে হত্যা করেছে। পরে সে হতভাগা বাঙালিদের মৃতদেহগুলোও জেলাখানা ও আশপাশের উন্মুক্ত জায়গায় ফেলে দিত। এখানেই মুক্তিযোদ্ধা ডোমাস চন্দ্রের  লাশ পঁচে গলে মাটির সাথে মিশে যায়। সে সময় কুকুর শৃগালের সাথে শত শত শকুন দলে দলে গলিত লাশ খেতে আসত কুড়িগ্রাম জেলখানার মাঠে। কুড়িগ্রাম স্বাধীন হওয়ার পর কুড়িগ্রাম কারাগার চালু প্রাক্কালে জেলখানা পরিষ্কার করতে গিয়ে জেলের অভ্যন্তরের সেল থেকে হাতকড়া পরিহিত একটি নরকঙ্কাল উদ্ধার হয়। পরে সে নরকঙ্কালটিকেও জেলখানা গণকবরের পাশে সমাহিত করা হয়। এভাবেই কুড়িগ্রাম জেলাখানার পূর্বদিকের ফাঁকা জায়গাটি গণকবর ও বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল।

ক্র. শহিদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পিতা/স্বামী ঠিকানা
শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ডোমাস চন্দ্র অজ্ঞাত অজ্ঞাত

(পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়)

সূত্র: উত্তর রণাঙ্গনে সংখ্যালঘু গণহত্যা ও নারী নির্যাতন- এসএম আব্রাহাম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!