You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.14 | নারী নির্যাতন, কুড়িগ্রাম - সংগ্রামের নোটবুক

নারী নির্যাতন কুড়িগ্রাম

প্রথম দফায় সাত এপ্রিল পাকিসেনারা কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। তারা শহরে ঢুকেই সি এন্ড বি রেস্ট হাউজের সামনে পাঁচজন কারারক্ষীকে গুলি করে হত্যা করে। ব্যাপক হত্যার পর তারা কুড়িগ্রাম ত্যাগ করলেও চৌদ্দ এপ্রিল পুনরায় কুড়িগ্রামে প্রবেশ করে স্থায়ীভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসে। সি এন্ড বি রেস্ট হাউজ ছিল তাদের অন্যতম নির্যাতন কেন্দ্র। কুড়িগ্রামের আদালত ভবন, পুরাতন শহরে রিভারভিউ হাইস্কুলসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্যাম্পে শত শত নারীকে নির্যাতন ও হত্যা করে। ১৪ নভেম্বর ভূরুঙ্গামারী মুক্ত হলে স্থানীয় সিও অফিসের দোতলা থেকে আটকে রাখা বিশ থেকে ত্রিশ জন ধর্ষিত তরুণীকে উদ্ধার করেন মুক্তিযোদ্ধারা। ঘরের তালা ভেঙ্গে শতছিন্ন শাড়ি পরা পঁচিশজন অনাহারক্লিষ্ট লাঞ্ছিত মেয়েকে মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পান। সেখানে দশ এগারো বছর বয়েসি একজন কিশোরীও ছিল। অত্যাচার ও লাঞ্ছনায় উদ্ধার হওয়া নির্যাতিত নারীরা অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। বন্দি মহিলাদের মধ্যে ছিলেন ভূরুঙ্গামারীর স্থানীয় মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষক আব্দুল লতিফের স্ত্রী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার তাঁর স্ত্রীকে নিজের লালসা চরিতার্থ করার জন্য দাবি করে। আব্দুল লতিফ তার অন্যায় দাবি প্রত্যাখ্যান করলে পাকসেনা তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাঁর স্ত্রীকে জোরপূর্বক ক্যাপ্টেন আতাউল্লাহর ঘরে নিয়ে যায়। দীর্ঘ পাঁচ মাস তাঁর উপর পাশবিক নির্যাতন চলে। পাকিবাহিনী এগারো বছরের কিশোরী জামিলা খাতুনকেও ধর্ষণ করে। ভূরুঙ্গামারী মুক্ত হবার মাত্র কয়েকদিন আগে কিশোরী জামিলা ও তাঁর মাকে তারা ধরে নিয়ে যায়। চল্লিশ বছর বয়স্ক আমিনা খাতুন সে সময় ছিলেন পূর্ণ গর্ভবতী। হানাদারবাহিনী তাদের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করতে গেলে তিনি প্রাণপণে বাঁধা দেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে সেই পাকিস্তানি সৈন্যটি তাঁর তলপেটে বুট দিয়ে আঘাত করলে আমিনা খাতুন একটি মৃত সন্তান প্রসব করেন। তারপরও আমিনা খাতুনকে ধর্ষণ থেকে একদিনও রেহাই দেয়নি নরপশুরা। ইরাবুদ্দিন নামে এক নিরীহ বাঙালি তাঁর স্ত্রীকে হায়েনাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করলে তাঁর পা সঙ্গীন দিয়ে এফোঁড় ওফোড় করে দেয়া হয়।
ভূরুঙ্গামারী এলাকায় পাকসেনা ও তাদের সহযোগী শান্তি কমিটির দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং ইস্ট পাকিস্তান ক্যাভালরী আর্মড ফোর্স (ইপিক্যাফ) ভূরুঙ্গামারী-কুড়িগ্রাম সড়ক, ভূরুঙ্গামারী-সোনাহাট সড়ক ও ভূরুঙ্গামারী-বাঘভান্ডার সড়কের দুই পাশের অসংখ্য বাড়িঘর, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করে। আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হক চৌধুরী, কাজিম উদ্দিন চেয়ারম্যান ও তমেজ উদ্দিন মন্ডল মেম্বারসহ কয়েকশত নেতাকর্মীর ও সাধারণ মানুষের বাড়িঘর, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে। আওয়ামী লীগ অফিসসহ ভূরুঙ্গামারী বাজারের সাহাপট্টি, দেবোত্তর মন্দির এবং ভূরুঙ্গামারী কলেজের অংশবিশেষ ধ্বংস ও লুটপাট করে।
এলাকায় পাকিস্তানি টর্চার সেল/বন্দীশিবির : ভূরুঙ্গামারী এলাকায় পাকিস্তানি টর্চার সেল/বন্দীশিবির ছিল যথাক্রমে—ভূরুঙ্গামারী সিও অফিস, ভূরুঙ্গামারী থানা, ভূরুঙ্গামারী কলেজ, ভূরুঙ্গামারী হাইস্কুল ও জয়মনিরহাট ডাকবাংলোসহ আরো অনেক পাকিস্তানি তাঁবু ক্যাম্প ছিল। এখানে প্রধান অত্যাচারী পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আতাউল্ল্যাহ খাঁনের নেতৃত্বে খোকা দালাল, কাদের মৌলভী ও মোবরক আলী সহ অনেক দালাল-রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষকে ধরে এনে তথ্য আদায়ে নির্যাতন করে হত্যা করত। ধরে আনা মেয়েদের ধর্ষণ কেন্দ্রে চালান দিত।
বীরাঙ্গনা সাজিরণ বেগম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আনসার কমান্ডার শহিদ তমিজ উদ্দিনের স্ত্রী। পাক সেনাদের ধর্ষণে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারান। মওলানা লতিফ মোল্লা নিজ স্ত্রীকে পাক সেনাদের হাতে তুলে দেয়, মেজরসহ পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করে। পরে সাজিরণ ধর্ষিতা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৪ নভেম্বর ভূরুঙ্গামারী মুক্ত করার সময় সিও অফিসে পাকিস্তানি বিধ্বস্ত বাঙ্কারে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আতাউল্ল্যাহ খাঁন এর লাশ বাঙালি অসহায় তরুণীর উলঙ্গ লাশকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় পাওয়া যায়। হতভাগা তরুণীটির লাশ শনাক্ত করা যায়নি। মুক্তিযোদ্ধারা সিও এর বাসভবন থেকে ৪ জন নারীকে উলঙ্গ অবস্থায় উদ্ধার করেন। কয়েকজন নারীকে সিও অফিসের দোতালা থেকেও উদ্ধার করা হয়। অনেক মেয়েদের ব্লাউজ, ব্রেশিয়ার, পেটিকোটসহ অন্যান্য বস্ত্রাদি সেখানে পাওয়া যায়। অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বন্দিখানার দেয়ালের গায়ে নিজের রক্ত দিয়ে কোনো এক বীরাঙ্গনা লিখেছিলেন “জ….বা”! তাঁর নাম ছিল জবা অথবা তিনি জয় বাংলা বোঝাতে চেয়েছিলেন। একইদিনে মুক্তিবাহিনী ভূরুঙ্গামারী হাইস্কুল ক্যাম্প থেকে আরও ১৬ জন ও কলেজ থেকে ২০ জন ধর্ষিতাকে উদ্ধার করে। পরে এই সকল বীরাঙ্গনাকে ভারতে পাঠানো হয়েছিল।

সূত্র: উত্তর রণাঙ্গনে সংখ্যালঘু গণহত্যা ও নারী নির্যাতন- এসএম আব্রাহাম