নিসবেতগঞ্জ গণহত্যা
মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিক পরিণতির দিকে দেশকে নিতে যাঁরা সংস্কৃতির জাগরণ ঘটাতে অবদান রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রংপুরের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংস্কৃতিসেবী এডভোকেট শ্রী বিজয় চন্দ্র মৈত্র সবার প্রিয় পাখিদা। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে রংপুর বারে তিনি আইন পেশায় যোগ দেন। শহরের গুপ্ত পাড়ায় থাকতেন। সংস্কৃতি কর্মী-সংগঠকদের ভরসার ঠিকানাই ছিলেন তিনি। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে যুক্ত লোকজনদের আড্ডার কেন্দ্রস্থল ছিল তাঁর বাড়িটি। তিনি রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করতেন সংস্কৃতির লড়াইয়ের মাধ্যমে। সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে তিনি রাজনীতিকে কল্পনা করেননি।
১০ মার্চের পর থেকে স্বাধীনতার সংগ্রামকে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে নিতে গ্রামেগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় নানা কমিটি গঠিত হতে থাকে। তেমনি পাকিস্তানিদের অত্যাচার ও হামলার পরিস্থিতি তৈরি হয়। সম্ভাব্য হামলা ও অত্যাচার থেকে বাঁচতে অনেকেই ভারতে তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে পরিবার পরিজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন। সেসব বুঝে তাঁর পরিচিতজন ও শুভানুধ্যায়ীরা এ মানুষটিকে দেশ ত্যাগের অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু তিনি অনড়, মাতৃভূমি ছাড়তে রাজি ছিলেন না। তিনি নিদারুণ দেশপ্রেম নিয়ে রংপুর শহরেই থেকে যান। সেই কঠিন সময়ে জন্মভূমি ত্যাগ না করে পাখি মৈত্র বলছিলেন—জন্মভূমির দুর্দিনে দেশ ত্যাগ করা মহাপাপ এবং অন্যায়। দেশের অবস্থা খারাপের দিকে গেলে তিনি তাঁর দু’ ছেলেকে পাঠিয়ে দেন শ্বশুরবাড়ি নলডাঙ্গায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি! পাকিস্তানিরা তাঁর দু’ ছেলে চুন্নী মৈত্র ও মুকুল মৈত্রকে বাঁচতে দেয়নি। সেখানেই তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা। ২৫ মে মধ্যরাতে গুপ্তপাড়ার বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় দখলদার বাহিনী পাখি মৈত্রকে। নিসবেতগঞ্জের বধ্যভূমিতে সবার সাথে পড়ে থাকে তাঁর লাশ।
এর আগে ২৩ মে ’৭১ রোববার রাতে লিচু বাগানে অপারেশন করে পাকিস্তানিরা। সে সময় রংপুর শহরের লিচু বাগান এলাকায় নিজ বাড়িতে রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন স্থানীয় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি শৈলেন দত্ত। এমন সময় গাড়ির শব্দ, হুইসেলের শব্দ, আর অসংখ্য বুটের খট খট আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে পড়ে সমগ্র লিচু বাগান এলাকা। ঘরে থেকেই সেসব শব্দ আর পরিণতির কথা বুঝতে পারছিলেন শৈলেন দত্ত। তিনি কিছু বুঝে উঠার আগেই তাঁর দরজায় হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ। সাথে সাথে অশ্লীলভাষায় গালিগালাজ। স্পষ্ট বাংলায় শোনা গেল শালা মালাউনের বাচ্চা দরজা খোল। বাধ্য হয়ে দরজা খুলে দেন শৈলেন দত্তের বড় বোন ইলা দত্ত। তিনি দেখেন মহল্লার পরিচিত কজনের পেছনেই পাকিস্তানি আর্মি। দরজা খোলা মাত্র তারা হুড় হুড় করে করে ঘরে ঢুকে পড়ে। শৈলেন দত্তকে ধরার জন্য আর্মিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল ছয়/সাতজন পাকিস্তানি দালাল। শৈলেন দত্তকে হায়নাদের হাতে তুলে দিয়ে সাথে থাকা রাজাকাররা গিয়ে ঢুকে অন্য দুটি বাড়িতে। সেখান থেকে ধরে নিয়ে যায় রংপুর শহরের প্রবীণ আইনজীবী পূর্ণচন্দ্র সরকার এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শঙ্কর বণিককে। তখন এলাকায় পিনপতন নীরবতা। মারতে মারতে এডভোকেট পূর্ণচন্দ্র সরকার এবং শঙ্কর বণিককে একটি আর্মি জিপে তোলা হয়। আরও অনেককেই তারা গাড়িতে তুললেও শৈলেন দত্তকে তারা জীপে না তুলে তারা তার পা দুটো রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে সেই রশির মাথা জীপের সাথে বেঁধে নিয়ে সবেগে গাড়ি চালায়। গাড়ির গতি যতই তীব্র হচ্ছিল ততই পিছনে শৈলেন দত্তের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ হচ্ছিল। তাঁর গগণবিদারী আর্তনাদে সমগ্র এলাকাটি অশ্রুসজল হয়ে যায়।
পরদিন সকালে মহল্লার মোড়েই পাওয়া যায় শৈলেন দত্তের রক্তে ভেজা লুঙ্গি। বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও যে শৈলেন দত্ত শহিদ হয়েছেন। এলাকায় কারও মুখে কথা নেই বোবা কান্নায় অধির সকলে। সব শুনশান বেলা বাড়তে থাকল। সকাল ১১টার দিকে খবর পাওয়া যায় রংপুর ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন নিসবেতগঞ্জ হাটে একই রাতে ৪০-৫০ জনকে গুলি করে মেরেছে পাকিস্তানিরা। আইনজীবী পূর্ণ চন্দ্র সরকার, শঙ্কর বণিকের লাশ সেখানে ছিল। ছিল না শৈলেন দত্তের লাশ। লিচু বাগান থেকে নিসবেতগঞ্জ হাট পর্যন্ত জীপের পিছনে বাঁধা শৈলেন দত্তের দেহ মিশে গেছে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পথের ধূলায়। নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এখানে সৈয়দপুর, নীলফামারী রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেককে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছিল যাঁদের মধ্যে অনেক সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্য ছিলেন। তাঁদের সকলের নাম পাওয়া যায়নি যাঁদের নাম পাওয়া গেছে তাঁরা হলেন—
ক্র. | শহিদের নাম | পিতার নাম | ঠিকানা |
১ | শহিদ মুকুল চন্দ্র মৈত্র | শহিদ বিজয় চন্দ্র মৈত্র পাখি | গুপ্তপাড়া, রংপুর |
২ | শহিদ চুন্নী চন্দ্র মৈত্র | শহিদ বিজয় চন্দ্র মৈত্র পাখি | গুপ্তপাড়া, রংপুর |
৩ | এডভোকেট পূর্ণ চন্দ্র সরকার | অজ্ঞাত | লিচু বাগান, রংপুর |
৪ | শহিদ শৈলেন দত্ত | অজ্ঞাত | লিচু বাগান, রংপুর |
৫ | শহিদ শঙ্কর বণিক | অজ্ঞাত | লিচু বাগান, রংপুর |
(পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়)
সূত্র: উত্তর রণাঙ্গনে সংখ্যালঘু গণহত্যা ও নারী নির্যাতন– এসএম আব্রাহাম