২৮ মার্চ আদিবাসী ও বাঙালিদের রংপুর সেনানিবাস আক্রমণ
মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে রংপুর ও দিনাজপুর জেলাব্যাপী রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনগুলো জনগণকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে ধাবিত করার জন্য বিশেষ প্রচার প্রচারণা শুরু করেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এম.এন.এ ও এ.পিএরা ছাড়াও, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল গণি, আমজাদ হোসেন, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে রফিকুল ইসলাম গোলাপ, হারেস উদ্দিন সরকার, ইলিয়াস আহমেদ, মাহবুবুল বারী, অলক সরকার, আব্দুর রহমান, আব্দুল আওয়াল টুকু, মুখতার ইলাহী (শহিদ), জিয়াউল হক সেবু, নজরুল ইসলাম হক্কানী, জাকির হোসেন সাবু, নুরুল হাসান, রোস্তম আলী, আকবর আলী, জায়েদুল হক, ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া নেতৃবৃন্দের মধ্যে খালেকুজ্জামান চৌধুরী, নুরুল রসুল চৌধুরী, মুফতি বেঞ্জুবর রহমান, আব্দুল মান্নান, ছাত্র ইউনিয়ন মেনন এর শেখ শাহী ও নূর আহমেদ টুলু, ভাসানী ন্যাপ নেতাদের মধ্যে অন্যতম ভূমিকা রাখেন এড. কাজি মহাম্মদ এহিয়া, মাহফুজ আলী জররেজ (শহিদ) ন্যাপ ওয়ালী কাজি আব্দুল হালিম, মোহাম্মদ আফজাল, শামসুজ্জামান, মুনিরুজ্জামান, আবু জাফর মুকুল, রহমত কবিরী, তৃপ্তি রায় চৌধুরী (তিপাইদি)। কমিউনিস্ট পার্টি নেতা মণিকৃষ্ণ সেন, আমজাদ হোসেন, শংকর বসু, জিতেন দত্ত, ছয়ের উদ্দিন প্রমুখ। ওই সকল দলের নেতা কর্মীরা জেলার বিভিন্ন এলাকায় সভা সমিতি করে জনগণকে বেগবান করার দায়িত্ব গুরুত্বের সাথে পালন করেন। রংপুর সেনানিবাসের চারদিকের গ্রামে বিশেষ করে বদরগঞ্জ শ্যামপুর, মিঠাপুকুর, রাণী পুকুর, জায়গীর, দমদমা, নিসবেতগঞ্জ, মানজাই, রানীহাট, রূপসী, তামফাট, জয় আনোয়ার, পালিচড়া, বুড়ির হাট, গঙ্গাচড়া, লালবাগ, গণেশপুর, দামোদরপুর, পাগলাপীর, সাহেবগঞ্জ, বাহার কাছনা এলাকাগুলো রংপুরের কাছাকাছি হওয়ায় ওই এলাকার মানুষজন শহরের যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামের উত্তাপের সাথে নিত্য যোগাযোগ রাখত। ওই অঞ্চলে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির গণসংগঠন কৃষক সমিতির শক্তিশালী অবস্থান ছিল। সংগঠনটি তামাক, পাট, ইক্ষু চাষীদের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে প্রতিনিয়তই লড়াই সংগ্রাম করত। সে কারণে কৃষক সমিতির শক্ত অবস্থান ছিল ঐ এলাকার জনগণের উপর, তাছাড়া সাঁওতাল, ওরাওঁ আদিবাসীদের সাথে কমিউনিস্টদের নিবিড় সম্পর্ক থাকার সুবাদে ওই সকল এলাকায় বামপন্থীরা স্বাধীনতার গতি প্রকৃতি নিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করতে থাকে। তখন সেখানে নেতা ছিলেন জিতেন দত্ত, ছয়ের উদ্দিন, শংকর বসুরা। স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৭ মার্চ পর্যন্ত রংপুরের নেতারা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করা হবে এ ধরনের কোনোও ঘোষণা না দিলেও প্রচার ছিল জনগণ সংগঠিত হতে পারলে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের বাঙালি সৈনিকরা সহযোগিতা করবে ফলে ক্যান্টনমেন্টের পাকসেনাদের পরাজিত করা যাবে। এ প্রসঙ্গে ইপিআরের রংপুর সেক্টরের উপ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজিস উদ্দিনের বিশেষ ভূমিকা ছিল।১৩ তিনি পরিস্থিতির আগাম অনুধাবনে ২৫ মার্চ রাত সাড়ে এগারোটার দিকে তিস্তা অভিমুখে যাওয়ার আগে রাত সাড়ে নটার দিকে তিনি মাহিমাগঞ্জের মোল্লা মাস্টারকে নিয়ে সেন পাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতা মতিয়ার রহমানের সাথে বৈঠক করে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের সিদ্ধান্ত নেন। পরে রংপুর ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্তে মোল্লা মাস্টারকে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের ইঙ্গিত দেন। নওয়াজিস উদ্দিনের সেদিনের ইঙ্গিত ধরে সেনানিবাস আক্রমণের ভিত্তি রচিত হতে থাকে। মোল্লা মাস্টার পরক্ষণই নিসবেতগঞ্জে শেখ আমজাদের সাথে দেখা করে এ বিষয়ে শেখ আমজাদ, এমপিএ সিদ্দিক হোসেন, রাণীপুকুরের আব্দুল গণি এবং মজিবর মাস্টারের সাথে যোগাযোগ করেন। এতদ্ব্যতীত প্রচার ছিল রংপুর সেনানিবাসে খাবার, অস্ত্রশস্ত্র, রসদ ফুরিয়ে গেছে এ খবর চারদিক ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা মনে করে ক্যান্টনমেন্টে সেনারা বেশ নাজুক অবস্থায় আছে। অতঃপর আদিবাসী জনতা ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করেন তীর ধনুক, বল্লমসহ দেশীয় নানা অস্ত্র নিয়ে। সেদিন বাঙালি ও আদিবাসীদের মিলিত আক্রমণকে পাকিস্তানিরা প্রতিরোধ করে বুলেট ও বেয়োনেট দিয়ে। তাদের আক্রমণে বাঙালিরা ও আদিবাসীদের রক্তে রংপুর সেনানিবাস রঞ্জিত হয়। ওইদিন শহিদদের লাশগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
২৮ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার পর এ অঞ্চলের মানুষ ভীত, আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায় এবং গ্রামের যুবকসহ সবশ্রেণি ও পেশার মানুষকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে থাকে। সে সময়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের ভূমিকা ছিল মুখ্য। রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোটখাটো প্রতিরোধও গড়ে উঠেছিল। রংপুর উইং হেডকোয়ার্টার থেকে যে সমস্ত বাঙালি ইপিআর পালাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তারা প্রায় সকলেই হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি
এবং নিহত হন। ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণে চল্লিশ-পঞ্চাশ গ্রামের সংগ্রামী মানুষজন অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁদের অধিকাংশই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাঁদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজ অবধি হয়নি যা দুর্ভাগ্যজনকই নয় হতাশাজনকও বটে। ওইদিন কয়েকশত আদিবাসী জীবন দিলেও তাঁদের তালিকাও প্রণীত হয়নি। শহিদের লাশগুলো পুড়িয়ে দেয়ার কারণে পরিবারগুলোও জানতে পারেনি তাঁদের সদস্যদের পরিণতির কথা। সেদিন কতজন বাঙালি ও আদিবাসী শহিদ হয়েছিলেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান আজও নেই। এ পর্যন্ত যাঁদের নাম পাওয়া গেছে তাঁদের মধ্যে সংখ্যালঘু সদস্য যাঁদের নাম পাওয়া গেছে তাঁরা হলেন—
ক্র. | নাম | পিতা | গ্রাম | ইউনিয়ন |
১ | শহিদ ভোদল | সমর | রামপুর | সাতগাড়া |
২ | শহিদ কেতু বাদ্যকর | চাঁদিয়া বাদ্যকর | বড়বাড়ী | চন্দনপাট |
৩ | শহিদ রেজিয়া খাতুন | অজ্ঞাত | বখতিয়ারপুর | অজ্ঞাত |
সূত্র: উত্তর রণাঙ্গনে সংখ্যালঘু গণহত্যা ও নারী নির্যাতন– এসএম আব্রাহাম