রংপুর বিভাগের প্রথম শহিদ শংকু সমাজদার
৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বক্তব্যর পর থেকেই মূলত: দেশজুড়েই সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু রংপুরে বাঙালি ও অবাঙালির লড়াই শুরু হয়েছিল ৭ মার্চের বেশ আগেই। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত সশস্ত্র লড়াই শুরু হয়। সামগ্রিকভাবে জাতি সাহসী হয়ে ওঠে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে। কিন্তু রংপুর উজ্জীবিত হয় তারও আগে। ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সারা দেশের ন্যায় রংপুর জেলার সর্বত্র পূর্ণদিবস হরতাল পালিত হয়। ওই হরতালে পিকেটিং দরকার হয় নাই, জনগণ নিজ দায়িত্বেই সেদিন হরতাল সফল করেছিল। ৩ মার্চ রংপুরের ইতিহাসে সেরা দিন। ওই দিন রংপুর কাচারী বাজার এলাকা থেকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে একটি ছোট মিছিল শুরু হয়ে শহর অভিমুখে যাত্রা করে। মিছিল যতই অগ্রসর হয় ততই মানুষ মিছিলে প্লাবনের মহাস্রোতের মতো অংশ নিতে থাকে। ফলে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মিছিলটি জনসমুদ্রে রূপান্তরিত হয়। শুধু তাই নয় মিছিলটি জঙ্গি রূপ পরিগ্রহ করে অথচ সুশৃঙ্খল ছিল। গগনবিদারী শ্লোগানে মিছিলটি প্রেসক্লাবের দিকে গেলে সেখানে মিছিলে যোগ দেন এমপিএ সিদ্দিক হোসেন। মিছিলে সবার এক শ্লোগান, ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। তোমার নেতা আমার নেতা-শেখ মুজিব, শেখ মুজিব, তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা। ছাত্রলীগ শুরু করলেও পরে মিছিলটি সর্বদলীয় মিছিলে রূপান্তরিত হয়। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন সিদ্দিক হোসেন এমপিএ, ডা. সোলায়মান মন্ডল, রফিকুল ইসলাম গোলাপ, খালেকুজ্জামান চৌধুরী, রেজাউল হক সোভা, আবিজার হোসেন, গোলাম মোস্তফা বাটুল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, মমতাজ, জাকির আহমেদ সাবু, হারেস উদ্দিন সরকার, ইলিয়াস আহমেদ, অলক সরকার, জায়েদুল, নুরুল হাসান, আবুল মনসুর আহমেদ, মুখতার ইলাহী, মাহবুবুল বারী, জিয়াউল হক সেবুসহ আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ওয়ালী, ন্যাপ ভাসানী, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া, ছাত্র লীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের অনেক নেতা কর্মী। মিছিলে শুধু কলেজের ছাত্ররাই নয় যোগ দিয়েছিল যেমন শহরের শ্রমিক, গ্রাম থেকে আসা যুবক—স্কুলের ছাত্ররাও পিছিয়ে থাকেনি। সকলের মিলিত মিছিল তেঁতুলতলা থেকে পুনরায় শহরে ফিরে আসার কথা ছিল কিন্তু পথিমধ্যে কারমাইকেল কলেজের ছাত্ররা মিছিলে অংশ নিলে তাদের এবং ফুলু সরকারের নেতৃত্বে আগত শ্রমিকদের চাপে মিছিলটি আলমনগর অভিমুখে স্টেশনের দিকে ধাবিত হয়। আলমনগর খাদ্য গুদামের কাছে পৌঁছে তখন হঠাৎ জনৈক অবাঙালি সরফরাজ খানের বাড়ি থেকে মিছিলে গুলি বর্ষিত হয়। উক্ত গুলিতে মিছিলে আগত গুপ্ত পাড়া অধিবাসী সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শংকু সমাজদার গুরুতর আহত হন। তাঁকে জনৈক মোসলেম উদ্দিন (পৌর কমিশনার) হাসপাতালে নেয়ার পথে শংকু সমাজদার অধিকতর রক্তক্ষরণে মারা যান। শংকুর মৃত্যুর সংবাদ মিছিলের হাজার মানুষকে আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে। মিছিলকারীরা শংকু হত্যার প্রতিশোধে মরিয়া হয়ে ওঠেন, মিছিলকারীরা সমগ্র শহরে অবাঙালিদের দোকানপাট ভাংচুর করে, আগুন দিতে থাকে। শংকুর মৃত্যুর পর্বে রংপুরের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পৃথক অবস্থান থাকলেও মৃত্যুর খবর পাওয়া মাত্রই ন্যাপ ওয়ালী নেতৃবৃন্দ মোহাম্মদ আফজাল, শংকর বসু, আজিজুল ইসলাম সেলিম প্রমুখরা মিছিলে এসে যোগ দেন। ওই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পথে নামেন ন্যাপ ভাসানী নেতা এডভোকেট মাহফুজ আলী জররেজ, কাজী মোহাম্মদ এহিয়া। হাজার জনতা সরফরাজ খানের বাসায় আক্রমণ করতে চাইলে ইপিআর সদস্যরা বাধা দেয়। এম এন এ ডা. সোলায়মান মন্ডল জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিয়ে জনগণকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অনুরোধ করেন। সমগ্র রংপুর শহরে শুধু নয় এ খবর তেঁতুলিয়া থেকে রৌমারী পর্যন্ত বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ৩ মার্চ বিক্ষোভ চলাকালে অবাঙালিদের আক্রমণে রংপুর শহরে আরও দু’জন বাঙালি শহিদ হন, এরা হলেন রংপুর কলেজের ছাত্র মিঠাপুকুরের আবুল কালাম আজাদ তিনি শহরের বাটার গলির মুখে গিনি একচেঞ্জের সামনে এবং ওমর আলী নামে একজন সরকারি চাকুরে তিনি দেওয়ান বাড়ি রোডে বুট হাউসের সামনে ছুরিকাঘাতে শহিদ হন। ওইদিন আহত হন রংপুর কলেজের ছাত্র সংসদের মিলনায়তন সম্পাদক মোহাম্মদ আলী এবং শরিফুল আলম মকবুল, এদের মধ্যে মকবুল একমাস তীব্র যন্ত্রণা ভোগের পর মৃত্যুবরণ করেন।
৩ মার্চ রংপুরের ডিসি শামীম আহসান পরিস্থিতি শান্ত করতে দুপুর ২:৩০ থেকে সান্ধ্যা আইন জারি করেন। রংপুরের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সন্ধ্যার পর খবর পেয়ে উত্তরের সকল জেলাগুলোতে বিক্ষোভ হয়। রংপুর জেলার প্রতিটি মহকুমায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। গাইবান্ধায় জাতীয় পরিষদ সদস্য লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে বিকেলে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় মিছিল করে। দিনাজপুর জেলায় এমএনএ আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ বামপন্থী সকল রাজনৈতিক দল দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলায় ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
৩ মার্চ থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত রংপুর শহর কারফিউর আওতায় ছিল। কারফিউ সাধারণ মানুষকে দমাতে পারে নাই বরং ব্যবসায়ীরা জনগণের সহায়তায় রংপুর ও সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের পৃথিবীখ্যাত ভাষণে রংপুরের নাম এসেছিল ৩ মার্চের গণহত্যার কারণে। ওইদিন ও জন বাঙালির প্রাণদান ইতিহাসে রংপুর বিভাগকে মহিয়ান ও অমরত্ব দিয়েছে। যার মধ্যে প্রথম শহিদ হচ্ছেন স্কুলছাত্র শহিদ শংকু সমাজদার। তিনি সমগ্র উত্তরবঙ্গে উত্তাল মার্চের প্রথম শহিদ।
সূত্র: উত্তর রণাঙ্গনে সংখ্যালঘু গণহত্যা ও নারী নির্যাতন- এসএম আব্রাহাম