You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিগাছার যুদ্ধ (৬আগস্ট, ২অক্টবরের ১৯৭১)

১৯৭১ সালে মুক্তাগাছা ময়মনসিংহ জেলার অধিনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ থানা। থানা সদরে উত্তর দিকে মাত্র ২কি.মি. দূরত্বে এর অবস্থান। সেই সময়ে প্রধান পাকিস্তানীা সড়কটি ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে মুক্তাগাছা থেকে জামালপুর সদর ছুঁয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত চলে গেছে। সেই কারণে মুক্তাগাছা যোগাযোগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
জুলাই মাসের শেষের দিকে ৭ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত হাবিলাদার মো. রফিজ উদ্দিন ভারতের তুরা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে উচ্চতর ট্রেনিং নিয়ে নিজ এলাকা মুক্তাগাছায় প্রত্যাবর্তন করেন সাথে ৯জন উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। মধুপুরের গভীর জঙ্গলে তিনি অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার দলটিকে বড় করতে থাকেন। পরিকল্পনা মুক্তিগাছার উপর দিয়ে পাকিস্তানীবাহিনীর সকল যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া আর সেই জন্য থানা আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ দখল করে নেয়া। প্রথম আক্রমণে তাদের অস্ত্র বলতে ছিল ১টা এলএমজি, ১টা এসএমজি,১১টা ৩০৩ রাইফেল আর প্রত্যেকের জন্য ২টা গ্রেনেড।
রেকি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ সদস্য ছিলেন স্থানীয়। মুক্তাগাছা থানার অবস্থান পথঘাট সবই ছিল তাদের নখদর্পনে। উপরক্ত মুক্তিযুদ্ধের প্রতি স্থানীয় জনগণের নৈতিক সমর্থন থাকায় তাদের কাছ থেকে যে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে মুক্তিযোদ্ধাদের বেগ পেতে হয়নি। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে কেউ কেউ দিনেরববেলা সাধারণ বেশ ধরে গোপনে থানা ও পাশিস্প্লার্ন্মীবর্তী এলাকা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে যেত এ জনয তারা কলা ও তরিতরকারি বিক্রেতার ছদ্মবেশে থানা সদরে আসতো, এগুলো বিক্রি করে আবার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে নিয়ে ফিরে যেত। তারপরও নির্দিষ্ট দিনে পাঠানো হয়। এ দু’জন মুক্তিযোদ্ধা থানা এবং পাশিস্প্লার্ন্মীবর্তী এলাকা পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। এ দু’জন ছিলেন আবদুল হোসেন এবং ইউনুস আলী। দু’জন জয়দা গ্রামের অধিবাসী। সারাদিন গোপনে মুক্তাগাছা থানার সদর এলাকা পর্যবেক্ষণ করে বিকেলে হানাদার বাহিনীর ময়মনসিংহ ফিরে যাওয়া নিশ্চিত হওয়ার পর তারা সস্তপর্ণে শত্রু এলাকা অতিক্রম করে দ্রুত নিজ ঘাটিতে ফিরে এসে অধিনায়কের কাছে অবস্থান অবস্থা সবিস্তরে বর্ণনা করেন। হাবিলদার মো. রফিক উদ্দিন তার দল্বলসহ নিয়ে মধুপুরের পাহাড়ি এলাকায় গাবতলী গ্রামে আত্মগোপন করে থাকতেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিন ৬ আগস্ট সূর্য ডোবার সাথে সাথে রাতের খাবার সেরে ১৫জন মুক্তিযোদ্ধা অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়ে নেন। সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রথমে মূল দলটি রাত ১১টায় মুক্তাগাছার ৩কি.মি. দক্ষিণে জয়দা গ্রামে এসে পৌছান। চারদিকে নীরব-নিস্তব্ধতা। জনগণের কোনো সাড়াশব্দ নেই কোনো বাড়িতে আলোও জ্বলতে দেখা যাচ্ছে না।
জয়দা পৌছে তারা যুদ্ধের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে মুক্তাগাছা থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। অতি সন্তর্পণে ৩কি.মি. রাস্তা অতিক্রম করতে তাদের ২ঘন্টা লেগে যায়। রাত ১টায় মূল দলটি এসে থানার কাছে অবস্থান গ্রহণ করে। হাবিলদার রেফাজউদ্দিনের অনুপস্থিতিতে অধিনায়ক হাবিলাদার মো. ইব্রাহিম মূল দলকে তিনটি দলে ভাগ করেন। ৩জনের দলকে থানা থেকে ২০০ মি. পশ্চিমে ডাবকির মোড়ে প্রধান সড়কের উপর নিয়োজিত রাখেন। আরো ৩জনকে পূর্বদিকে নয় মাইল বাগান নামক স্থানে সড়কে নিয়োজিত করা হয়। এক্যাশন পার্টিতে অধিনায়কের সঙ্গে থাকেন ৮জন মুক্তিযোদ্ধা। ভারী অস্ত্র বলতে ১টি মাত্র এলএমজি। এলএমজিটি থানার সম্মুখে একটি উচু স্থানে স্থাপন করা হয়। প্রত্যেকের সাথে ৩০৩ রাইফেল এবং গ্রেনেড। আক্রমণের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল রাত ১টা। আক্রমণকারী দল থানার কাছে পৌছে দেখে নিভু নিভু আলোতে একজন মাত্র পুলিশ কনস্টেবল পাহারা দিচ্ছে। সে বুজে ওঠার আগেই অধিনায়কের নির্দেশে নায়েক মো. সামছুল আলম গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। অব্যর্থ লক্ষ্য। গ্রেনেডের বিস্ফোরণের আঘাতে সেন্ট্রি সেখানেই ঢলে পড়েন একই সাথে মূল দল এলএমজি এবং রাইফেলের গুলিতে থানাঘর ঝাঁজরা করে দেয়। পুলিশের বাকি সদস্যরা তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। আচমকা আক্রমণে হতচকিত হয়ে তারা কোনো প্রতিরোধের চেষ্টা না করেই পেছনে দিকের পুকুর সাঁতরিয়ে পালিয়ে যায়। ঐদিকে মুক্তিবাহিনীর কোনো সদস্য না থাকায় তারা পালাতে সক্ষম হয়। এরপরও আধঘন্টা বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর অধিনায়ক তার দলকে নিয়ে ঝটিকা বেগে থানার ভিতরে প্রবেশ করেন। কিন্তু তখন থানাতে আর কেউ নেই। সব অস্ত্রশস্ত্র ফেলে তারা পালিয়ে গাছে। গ্রেডেনের আঘাতে আহত পুলিশকেও সেখানে পাওয়া গেল না। এখানে তারা ১৪টি ৩০৩ রাইফেল,১টি টেলিফোন সেট,দু’টি কার্তুজ এবং প্রচুর গোলাবারুদ হস্তগত করেন। এগুলো সাথে নিয়ে দলনেতা সফল অভিযান শেষ করে নিজের স্থানে ফিরে আসে। ময়মনসিংহ থেকে ৭১উইং রেঞ্জার্স সহযোগী আলবদর এবং রাজাকার সাথে নিয়ে মুক্তাগাছা সদরে পৌছে অবর্ণনীয় নির্যাতন শুরু করে। ভয়ে এলাকার মানুষ আগেই নিরাপদ দূরত্বে সরে গেছে। কাউকে না পেয়ে হানাদার বাহিনী এবং তার দোসর এদেশীয় আলবদরের দল বাজার লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেক বাড়িঘর আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়।
অভিজ্ঞ কমান্ডার রেফাজউদ্দিন জানতেন হানাদার বাহিনী তাদের খুজে বের করতে মধুপুর জঙ্গল ঘিরে কম্বিং অপারেশন চালাবে। তাই তিনি ৭ তারিখ রাতেই আস্তানা ছেড়ে সদলবল ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। তাছাড়া তাদের গোলাবারুদও সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা ছিল।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!