You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তাগাছা থানা দ্বিতীয় আক্রমণ (২অক্টবর,১৯৭১)

মুক্তাগাছা থানা দ্বিতীয় অভিযান পরিকল্পিত আক্রমণ। অধিনায়ক হাবিলদার মো. রেফাজউদ্দিন ভারতের তুরা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে বসে সহ-অধিনায়ক এবং ক্যাম্প কমান্ডার শহীদ নাজমুল আহসানের সাথে পরামর্শক্রমে মুক্তাগাছা থানা দ্বিতীয়বার আক্রমণ পরিকল্পনার চূড়ান্ত করেন। এবার তার দলে মুক্তইযোদ্ধার সংখ্যা বাড়িয়ে ৮১জন করা হয়। সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পান হাবিলদার মো.ইব্রাহিম। বড় ধরনের অভিযান পরিকল্পনা নিয়ে তাকে প্রচুর অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক দেয়া হয়। সব ঠিক হলেও যাত্রার তারিখ গোপন রাখা হয়। এই দলকে তুরা ক্যাম্প থেকে পথ চিনিয়ে গন্তব্যে পৌছানোর জন্য দু’জন পরিদর্শক (গাইড) দেয়া হয়।
২৪ অক্টোবর সন্ধ্যার পরই হাবিলদার রেফাজউদ্দিন ও তার সহ-অধিনায়ক হাবিলদার মো. ইব্রাহিম কোম্পানির সকল সদস্যকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যাত্রার জন্য ত্বরিৎ প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। যদিওসবাই জানতো যে কোনো মুহূর্তে তাদের যুদ্ধ যাত্রার ডাক পড়বে। অদম্য সাহসী যুবকরা যুদ্ধকে ভয় পেত না, মৃত্যু ভয়ও তাদের পিছু টানেনি। যোদ্ধার জাতি না হয়েও সামান্য যুদ্ধবিদ্যা অর্জন করে তারা একটি দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সমান লড়াই করেছে, মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য। ২৪ অক্টোবর সন্ধার পর তুরা ক্যাম্প থেকে বিদায় নিতে আসেন হাবিরদার রেফাজউদ্দিন এবং তার এক কোম্পানি সৈন্য। এবার তার মনে শত্রুবাহিনীর বুরুদ্ধে বড় ধরনের কিছু ঘটানোর অদম্য স্পৃহা। তুরা ক্যাম্পে তাকে বিদায় জানান নাজমুল এবং ক্যাপ্টেন মুরারী।
সঙ্গের দু’জন গাইড পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে কিছুদূর এগুতেই তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পেতে রাখা মাইন ফিল্ডের ভিতর ঢুকে পড়েন। মাইন বিস্ফোরণে মুক্তিযোদ্ধা মো. সামছুল আলমের একটি পা উড়ে যায়। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা হতচকিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এই সময় পথ প্রদর্শনকারীদের একজন মুক্তিবাহিনীর একটি দলকে শত্রুবাহিনীর বিওপি এর দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্কতা এবং পরিচিত এলাকা হওয়ায় তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তার এই আচরণে সন্দেহ করা হয় যে, সেই পথপ্রদর্শক মূলত শত্রুপক্ষের গুপ্তচর ছিল। এরপর আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিস্ফোরণের পর বাকি মুক্তিযোদ্ধারা হতবুদ্ধি এবং দিক হারিয়ে ফেলেন। হাবিলদার মো. রফিজউদ্দিন রাতেরবেলা দিক নির্দেশনার প্রশিক্ষণকে কাজে লাগিয়ে (ধ্রুব তারার সাহায্যে দিক ঠিক করে ) ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তাগাছার কাছাকাছি নিয়ে আসতে সক্ষম হন। অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারাও পৃথকভাবে গাইডকে সাথে নিয়ে একই স্থানে এসে মিলিত হয়। এখানে পৌছানোর পর আর ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা তার দলে অন্তর্ভুক্ত হন। ৯৫ জন মুক্তিযোদ্ধার বিশাল বাহিনী দিনের বেলা মুক্তাগাছা থেকে বিশ কি.মি. উত্তর-দক্ষিণে কলাইত্তা গ্রামে পৌছে আত্মগোপন করে থাকে। মুক্তিবাহিনীর অধিকাংশই ছিলেন স্থানীয়। ফলে তাদের আত্মীয়স্বজনবৃন্দ তাদের আশ্রয় দিয়েছে সানন্দে। তাছাড়া পাকিস্তানীবাহিনী তখন সম্পৃর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন, যে জন্য এত বৃহৎ একটি দলের উপস্থিতি সত্ত্বেও সেনাবাহিনী সে খবর জানতে পারেনি।
২৭ অক্টোবর পৃর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অধিনায়ক হাবিলদার মো. রেফাজউদ্দিন থানাকে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। আক্রমণের পূর্বে তিনি তথ্য সংগ্রহ করেন যে, থানাতে পুলিশ ছাড়াও রাজাকার এবং আলবদর মিলিয়ে দুই কোম্পানি সশস্ত্র সদস্য অবস্থান করেছে। তবে এখানে রাত্রিকালীন সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য অবস্থান করে না। সারাদিন থেকে তারা সন্ধ্যার পূর্বে ময়মনসিংহ ফিরে যায়।
কমান্ডার হাবিলদার মো.রেফাজউদ্দিন মুক্তাগাছা শহরের তিন্দিকে চারটি কাটঅফ পার্টি মোতায়েন করেন। শহরের পশ্চিম দিকে ভাপকি মোড়ে ১টি, উত্তর দিকে ২টি কাটঅফ পার্টি বসান, এর ১টিতে ৬জন অন্যটিতে ৩০ জনকে রাখা হয়। পার্টি নিয়োজিত করা হয় যার সদস্য সংখ্যা ১২ জন। মুক্তিযোদ্ধা দল পরিকল্পনা অনুযায়ী কলাইত্তা গ্রাম থেকে রাত ১১টায় টার্গেট মুক্তাগাছা থানার উদ্দেশ্যে একত্রে রওয়ানা হয়ে বন বাংলা, বিটিবাড়ি গ্রামের মধ্যদিয়ে গোয়াইল গ্রামের এসে মিলিত হয়। গোয়াইল গ্রাম থেকে ৪টি কার্টওফ পার্টিকে পূর্বাহ্নেই নিজ নিজ অবস্থানের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। থানার উভয় দিকে বটতলায় ল্যান্স নায়েক ইদ্রিসের নেতৃত্বে ৬জন মুক্তিযোদ্ধাকে কাভারিং প্রদানের জন্য রাখা হয়। থানায় প্রবেশের জন্য ৩৫ জনের একটি চৌকস দলকে নির্দিষ্ট রাখা হয়। তারা গোয়াইল গ্রাম থেকে থানার কাছাকাছি পৌছে দু’দিকে ভাগ হয়ে থানার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সব পার্টি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান গ্রহণের পর আক্রমণ করলে পুলিশ এবং রাজাকার এবারও যে কোনো প্রতিরোধের চেষ্টা ছাড়াই থানার পিছন পথে পালিয়ে চলে যায় কিন্তু থানা দখলের পর মুক্তিযোদ্ধারা নির্ধারিত স্থানে মিলিত হওয়ার জন্য যখন ফিরে আসছিল তখন পাশিস্প্লার্ন্মীবর্তী মসজিদে অবস্থানকারী রাজাকারদের গুলিতে ৫জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। থানা আক্রমণকালে কতজন পুলিশ এবং রাজাকার নিহত এবং আহত হয়েছে তার পরিসংখ্যান জানা যায়নি। কারণ পরদিন সেনাবাহিনী মুক্তাগাছাতে কারফিউ ঘোষণা করে মুক্তিবাহিনীর সন্ধান চালাতে থাকে। এই সময় সামরিক ট্রাকে নিহত রাজাকার ও পুলিশের লাশ উঠিয়ে ময়মনসিংহ নিয়ে যাওয়া হয়। দ্বিতীয়বার বিজয়ের ফলে মুক্তিবাহিনীর মনোবল দ্বিগুন বেড়ে যায়।
রিয়াজ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!