You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.17 | হুশুরখালী যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক

হুশুরখালী যুদ্ধ
[অংশগ্রহণকারীর বর্ণনা]

প্রথম দিনঃ সেপ্টেম্বর-অক্টবরে কয়েকটি উত্তেজনায় ঘটনায় পাক হানাদারদের হুশুরখালী সীমারেখায় মুক্তাঞ্চল আক্রমণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে দস্তগীর হত্যা, রাজাকার বন্দী ও শবেবরাতের দিন হানাদারদের বাড়া ভাতে ছাই দেয়ার ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে পাকবাহিনী। শবেবরাতের পরদিন থেকে সম্মুখ যুদ্ধের প্রস্তুতি আরম্ভ হয়। যে কোনো মূল্যে মুক্তাঞ্চল রক্ষা করতে হবে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে ১৭ অক্টোবর খুব সকালে সংবাদ আসে ওরা যে কোনো সময় আক্রমণ হবে। এক কোম্পানি হানাদারের সাথে সম্মুখযুদ্ধে মূল ঘাটতি ছিল অস্ত্র ও গোলাবারুদ। অস্ত্রের মধ্যে ছিল মাত্র ব্রিটিশ মডেলে পুরাতন এলএমজি, কিছু এসএলআর গোটা কয়েক এসএমজি (যা সম্মুখ যুদ্ধের অনুপযোগী), মান্ধাত্বা আমলের থ্রি নট খ্রি, গ্রেনেড ইত্যাদি। আমাদের প্রতিরক্ষা সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে শত্রু এলাকা বিভাজনকারী খালের বিপরীত দিকে শত্রুদের সম্ভাব্য অবস্থানে গোপনে এন্টি পারসোনাল মাইন পুতা হয়। কাছাকাছি অবস্থানে জাম্পিং মাইন স্থাপন করা হয়। বুবি ট্র্যাপ করা হয় কোনো কোনো জায়গায়। যেখানে শত্রুরা বাধ্য হয়ে অবস্থান নেবে এমন স্থান, যেমন-ক্ষেতের আইল,খেজুর গাছের গোড়ায় শত্রুদের জন্য পেতে রাখি মরণ ফাদ। হানাদারদের মেরুদন্ডে আঘাতে হানার জন্য মাহাতাবের নেতৃত্বে এলএমজি পোস্ট করা হয় প্রতিরক্ষা ব্যূহের মাঝামাঝি স্থানে। অসীম সাহসী বীরযোদ্ধা মাহাতাব প্রতিরক্ষা ব্যূহের মূল মনোবল। প্রতিরক্ষা লাইনের আসল ভরসা ছিল মাহাতাবের কাছে থাকা ব্রিটিশ মডেলের এলএমজিটি। বেলা ১১ টায় শত্রুদের কলাম এগিয়ে আসতে থাকে। কোনো রাস্তা না থাকায় ওরা কেউ গ্রামের ভেতর দিয়ে, কেউ মেঠো পথ ধরে এগিয়ে আসে। ওদের সাথে ছিল চাইনিজ এলএমজি ও রাইফেল। মাথায় হেলমেট আর খাকি ড্রেস পরা হানাদার কাছাকাছি চলে এলেও ফায়ার করা ছিল নিষিদ্ধ। খাল পার হবে ওরা। প্রয়োজন পড়বে নৌকা বা সাঁকোর। একটি মাত্র সাঁকোর পথ ধরে এগিয়ে আসে বিশ্বাসঘাতক রাজাকাররা। সাঁকোর গোড়ায় পোতা ছিল বেশ কিছু এন্টি পারসোনাল মাইন, ২টা বুবি ট্র্যাপ। হানাদাররা উচ্চ স্বরে কথা বলতে বলতে খালপাড়া দিয়ে হেঁটে চলে সাঁকোর দিকে। মাত্র ৬০-৭০ গজ দূরে দিয়ে যাচ্ছিল এক এক করে। কয়েকটা এলএমজি থাকলে ব্রাশ ফায়ারে নিশ্চিহ্ন করা যেত ওদের পুরো কলামটি। খুব আফসোস হচ্ছিল। পরিকল্পনা ছিল সাঁকোর গোড়ায় পৌঁছা মাত্র জাম্পিং মাইনের নিস্ফোরণ ঘটাবে এক নম্বর গ্রুপ। সাথে সাথে ফায়ার ওপেন হবে। হলোও তাই। আচমকা আক্রমণে লুটিয়ে পড়ল হানাদারদের অগ্রবর্তী দল। সাকোর এক মাথা হানাদারদের নিয়ে শূন্য উড়ে গেল। বেচে যাওয়া হানাদাররা পজিশনে গিয়ে হামলার শিকার হলো এন্টিপারসোনাল মাইনের। হতভম্ব হয়ে পড়ে খান সেনারা। রাজাকাররা যে যার মতো পালাচ্ছে, গুলি খেয়ে শুয়ে পড়ছে কেউ কেউ। সমন্বয়ে জয়বাংলা শে-গান দিয়ে ওঠে সবাই। গোলাবারুদ কম থাকায় প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও গুলি হয়েছে হিসাব করে। ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাওলে এদিন হয়তো দত্তনগর,হাসাদহ আর্মি ক্যাম্প থেকে নতুন করে সেনা আসে ওদের সাহায্যে। বিকেলে ভারী মেশিনগান থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে থাকে হায়েনার দল। বাঁশঝাড়, গাছপালা ঝাঝ্রা হয়ে যায় শত্রুর গুলিতে। মাঝে মাঝে জবাব দিচ্ছে মুক্তিবাহিনী। কিছু সময় বিরতি দিয়ে মাহাতাবের এলএমজি গর্জে উঠেছে এলএমজি’র শব্দ শুনে সকলের মনোভাব চাঙ্গা থাকে। গোলাগুলি চলছে। হানাদারদের তুমুল গুলি বর্ষণের মাঝে পজিশন ছেড়ে ওঠার উপায় ছিল না কারো। অন্য গ্রুপের অবস্থান সম্পর্কে খবর নেয়ার কোনো উৎস ছিল না যোগাযোগ নেটওয়ার্ক যুদ্ধের অন্যতম প্রয়োজনীয় শর্ত। ওয়্যারলেস সেট বা ওয়াকিটকি না থাকায় যার যার দায়িত্ব পালন করতে থাকি স্ব স্ব অবস্থানে থেকে। অনুমান করে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি বুঝে নিতে হয়। দ্রুত সংবাদের ভিত্তিতে কয়েক মিনিটের মধ্যে একত্রিত হয় সবাই। মারাত্মক কোনো জখম ছিল না কারো। শুধু ভয়ে নাকি কয়েকজন পজিশন ছেড়ে পালিয়েছে।সারাদিন না খেয়ে শুকিয়ে গেছি সবাই। কে একজন গ্রামবাসী গামলা ভর্তি খিচুড়ি দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে সবাই। খাবার শেষে মাহাতাবের পজিশনে গিয়ে পরবর্তী করণীয় বিষষে কথা বলি। সারাদিনের যুদ্ধে ক্লান্ত অনেকেই নিকটবর্তী বাড়িঘরে বিশ্রামে চলে যায়। খেজুর পাতার শুকনো বিছানায় বুকে অস্ত্র রেখে ঘুমিয়ে পড়ে সহযোদ্ধারা। দেশের স্বাধীনতার জন্য বীর যোদ্ধাদের এ স্বচ্ছা সমর্পণ মুক্তিযুদ্ধকে করেছেও মহামান্বিত। দেশে দেশে মুক্তি সংগ্রামে হয়তো এমনই হয়েছে সর্বত্র আলজেরিয়া,কিউবা,ভিয়েতনাম,কম্বোডিয়ার মতো অনেক দেশের সূর্য সস্তানেরা এমনিভাবে জীবনকে সমর্পণ করেছে দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য। মালেক,মাহাতাব,নিজাম,ফজলুসহ আমরা বেশ কয়েকজন পরবর্তী দিনের বিষয় আলোচনা করি। পরদিন সকালে কয়েক গুণ শক্তি নিয়ে ওরা আবার আক্রমণ করবে এটা নিশ্চিত। যুদ্ধক্লান্ত শরীর নিয়ে নতুন করে মাইন পুঁতি শত্রু অবস্থানে। খাবার সরবরাহের বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এলাকায় স্বাধীনতার পক্ষে যারা জোরালোভাবে কাজ করেছেন বিষয়টি তাদের উপর ছেড়ে দিই। শুধু জানিয়ে দিই,মুক্তাঞ্চল রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ প্রতিটি যোদ্ধা। আমরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাবো। আমরা কৃতজ্ঞ এলাকার সাধারণ মানুষের প্রতি। রাত দশটার দিকে গামলা ভর্তি মাংস আসে আমাদের জন্য। সাধারণ মানুষের ভালবাসা দেখে আমাদের হৃদয় কেঁদে উঠে। মাহাতাবকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠি, দেশের স্বাধীনতা শুধু সময়ের ব্যাপার। মাহাতাবের ভাসা ভাসা বড় দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। নাসির মাকে জড়িয়ে ধরে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। ওদের চোখের পানিতে যুদ্ধ ক্লন্তি ,মুছে দেয় পরম আবেশে। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাদেরকে খাবার,আশ্রয়, তথ্য,সাহস দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল এদেশের সাধারণ মানুষ। অস্ত্র না দিয়েও ইতিসাহের নেপথ্যে কুশিলবের কাজ করেছে আপামর জনতা। ঐ রাতে পুনরায় বিএলএফ বাহিনীকে আমাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণের আবেদন জানাই। ওরা ছিল নিরুত্তাপ। এদিকে আমরা জীবন বাজি রেখে করছি, অপরদিকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবসরে ছিল ওরা। আমরা ওদের বিবেককে তিরস্কার করি। সেদিনের প্রতিক্রিয়ায় খুবই মঙ্কখুণ্ন হই আমরা। মানুষের জীবন, সম্পদ, স্বাধীনতা হুমকির মুখে জেনেও বাহিনীটির নীরবতা এলাকায় মানুষদের মধ্যে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নিরাশ না হয়ে নিজেদের শক্তি দিয়ে প্রতিরক্ষা কৌশল নির্ধারণ করি। অপেক্ষার প্রহর চলে নতুন এক দিনের জন্য, শত্রুকে নতুনভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য-বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।
দ্বিতীয় দিনঃ সকাল আটটায় শত্রুর ভারী মেশিনগানের ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি প্রকম্পিত করে তোলে যুদ্ধ প্রান্তর। গর্জে ওঠে মাহাতাবের এলএমজি। বিভিন্ন পজিশনে থেকে সমর্থন দেই আমরা। শত্রু পক্ষের গুলি থামার লক্ষণ নেই। বিরতিহীনভাবে আসতে থাকে গুলি বৃষ্টি। নিশ্চিত হই ওরা এগোচ্ছে আমাদের দিকে। মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে শত্রুর অগ্রবর্তী দল পর্যবেক্ষণ করছি। পূর্বদিনের চেয়ে সংখ্যায় বেশি মনে হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য হায়েনাদের। আমাদের পাতা কয়েকটা ট্র্যাপে পড়ে প্রাণ হারায় অগ্রবর্তী বাহিনীর কিছু সেনা। এন্টি পারসোনাল মাইনের জন্য হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে পারছিল না হানাদাররা। তাছাড়া খেজুর গাছের গোড়ায়,ক্ষেতের আইলের মধ্যে মাইন থাকায় মৃত্যু ঝুঁকি ছিল ওদের। তবে এদিন বেশ কিছু সেনা খালের অপর প্রান্তে একবারে কাছাকাছি আমাদের মুখোমুখি হয়। আমাদের প্রতিরক্ষার প্রধান সহায় ছিল স্রোতস্বিণী খালটি। শত্রুরা একেবারে কাছে এলেও খাল পার হওয়া ছিল দুঃসাধ্য। খালের ওপর ছিল আমাদের সতর্ক দৃষ্টি। ‘মালাউন কা বাচ্চা, ইন্দিরা কি বাচ্চা’-এসব খুব বাজে বাজে গালি দিচ্ছিল ওরা। জবাব দিচ্ছিলাম আমরাও। সমস্বরে জয়বাংলা শে-গান দেই। একটা পজিশন থেকে জয়বাংলা শে-গান উঠলে সবাই চিৎকার দিয়ে উঠতাম। কাছাকাছি অবস্থানে থাকা শত্রুর ওপর গ্রেনেড ছুড়েছি মাঝে মাঝে। আর জাম্পিং মাইনের বিস্ফোরণ ছিল শেষ অস্ত্র। পাল্টা-পাল্টি গুলি চলে সারাদিন। শত্রুর প্রচন্ড ও প্রবল আক্রমণের মাঝেও আকড়ে থাকি পজিশন। বিএলএফ এর সহযোগিতা না পাওয়ার যন্ত্রণা অনুভব করি প্রতি মুহূর্তে। এদিনও দুপুরে খাবার সুযোগ হয়নি। কাপড়ের পুঁটলিতে রাখা শক্ত আটার রুটি অনেক কষ্টে চিবিয়ে খায় কেউ কেউ। সাহসিকতার সাথে দ্বিতীয় দিনও অক্ষত রাখি আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ। তবে দ্বিতীয় দিন শেষে গোলাগুলির ভান্ডার প্রায় শুন্য হয়ে আসে আমাদের। শত্রুরা ফিরে যায় ছাউনিতে। সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার বয়রা থেকে গোলাগুলির সরবরাহ নেয়া ছিল দুঃসাধ্য। কমপক্ষে তিনদিনের ব্যাপার। আমাদের মধ্যে যাদের গুলি ফুরিয়ে যায় তাদের কেউ কেউ মূল ক্যাম্পে গোলাগুলি সরবরাহ নেয়ার জন্য চলে যায়। দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধ শেষে সত্যিকার অর্থে আমরা ঢাল তলোয়ারহীন হয়ে পড়ি। অবশিষ্ট মাত্র কয়েকশত রাউন্ড গুলি। যুদ্ধ কতদিন চলে ঠিক নেই। এভাবে চললে তৃতীয় দিনের পর পজিশনে ছেড়ে দিতে হবে। দুশ্চিন্তার ভাজ পড়ে সকলের কপালে। সন্ধ্যার পর সবাই একত্রিত হই। সাথে থাকা অবশিষ্ট মাইন শত্রু এলাকায় পুঁতে রাখি। রাতে হানাদার বাহিনী ক্যাম্পে যাওয়ার কারণে ওদের পজিশনে কেউ থাকে না। এ সুযোগে সদ্ব্যবহার করি আমরা। এদিন রাতে আবারও বিএফএল-কে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনুরোধ করি। তাদের লোকবল,অস্ত্রশস্ত্র আমাদের সাথে যোগ হলে শত্রুকে মোকাবিলা করা সহজ হবে বলে স্মরণ করিয়ে দেই।
তৃতীয় দিনঃ তৃতীয় দিন ভোর থেকেই শুরু হয় শত্রুর আক্রমণ। কয়েকটা ভারী মেশিনগান থেকে গুলি হচ্ছিল অনবরত। সকাল নয়টার দিকে আমার ট্রেঞ্চের দশ গজের মধ্যে মাহাতাবের এলএমজি পোস্টের কাছাকাছি পর পর কয়েকটা মর্টার শেল আঘাত হানে। আমরা শত্রুপক্ষের এ ধরনের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকলেও জবাব দিতে পারছিলাম না। ওরা মাঝে মাঝে শেল ছূড়ছিল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শত্রুর আক্রমণের তীব্রতা বাড়তে থাকে। সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের ওপর। থ্রি নট থ্রি আর পুতে রাখা কয়েকটা মাইনের উপর ভর করে পজিশনে টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা চালাতে থাকি। ইতোমধ্যে এলাকাবাসীর চাপে বিএলএফ এ বীর যোদ্ধা আমিনুল হক এলএমজি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন শত্রুর ওপর। এর মধ্যে মাহাতাব জানায় তার এলএমজি’র ব্যারেল প্রচন্ড গরম হওয়ার কারণে যে কোনো মুহূর্তে অকেজো হয়ে যেতে পারে। জীবনের ঝুকি নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে মাহাতাবের পজিশনে যাই। যেয়ে দেখি সে আদল-বদল করে করে কখনো এলএমজি কখনো এসএলআর চালাচ্ছে। বাঘের মতো হুংকার ছেড়ে অসীম সাহসী মাহাতাব শত্রুকে প্রতিহত করে চলে। আমরা যখন উত্তর দিকে শত্রুকে প্রতিহত করে চলেছি, সে সময় স্থানীয় দালালদের সহায়তায় পশ্চিম দিক দিয়ে পাকবাহিনী আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহের মাঝে ঢুকে পড়ে। পজিশন ছেড়ে পিছু হটতে হয় আমাদের। সময় তখন আনুমানিক বিকেল তিনটা। আহত হাবিবুল্লাহকে একটা ধান ক্ষেতে পড়ে যেতাম। এ সময় আসতে হয় আমাদের। একটু বিলম্ব হলে হয়তো সবাই ধরা পড়ে যেতাম। এ সময় নাসির, নুরুল ইসলাম, শাজাহান অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেয়। মাহতাবকে অনেক কষ্টে পজিশন থেকে তুলে আনতে হয়। ইতোমধ্যে সানোয়ার নামে এক সহযোদ্ধা শত্রুর হাতে ধরা পড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সমস্ত হুশুরখালীর বাড়িঘরে এক এক করে আগুন ধরিয়ে দেয় হানাদারদের সাথে আসা রাজাকাররা। চোখের সামনে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা হুশুরখালী গ্রাম। আগুনের লেলিহান শিখায় ঢাকা পড়ে যায় সূর্য। কালো ধুয়ায় ছেয়ে যায় সারা আকাশ। আমরা ধীরে ধীরে পিছু হটে হুশুরখালী গ্রামের প্রান্তসীমায় নতুন করে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলি।অবসন্ন দেহকে বড় ভারী মনে হয়। মনে হয় আমরা হেরে গেছি আমাদের কাছে। বিএলএফ ঠিক সময়ে অস্ত্র, গোলাবারুদ দিয়ে সহায়তা করলে হয়ত শত্রুকেই দত্তনগর ক্যাম্প ছেড়ে পালাতে হতো আজ। আমাদের অবস্থান টের পেয়ে হানাদার বাহিনী অব্যাহত গুলিবর্ষণ করতে থাকে। প্রতিরোধের মুখে তারা মুখে তারা আর এগোতে পারেনি। সন্ধ্যার কিছু আগে হুশুরখালী গ্রামকে নিশ্চিত করে ওরা ফিরে যায় দত্তনগর ক্যাম্পে। যাওয়ার সময় রাজাকাররা গ্রামে গরু,ছাগল,ধান,চাল, কাথা-বালিশ,হাড়ি-পাতিল লুট করে নিয়ে যায়। বেশ কিছু মুরগির খোঁয়াড়ে আগুন দিয়ে শত শত মুরগি হত্যা করে। ওরা ঘাটি,বদনা পর্যন্ত সাথে করে নিয়ে যায়। বাড়ির আঙ্গিনার ফল-মূলের গাছ কেটে নষ্ট করে। এমনকি টিউবওয়েলের মধ্যে মূত্র ত্যাগ করে। হুশুরখালী গ্রামের মক্তবটি ওরা জ্বালিয়ে দেয়। সেখানে অনেক কুরআন, কায়দা, ছিফারা, হাদীসের বই ছিল। ওরা নাকি খাটি মুসলমান। শান্তির ধর্ম ইসলামের ধারক ও বাহক বলে দাবি করত পাকিস্তানীরা। অথচ শরীআত বিরোধী কাজ করেছে একাত্তরে। মসজিদ, কুরআন রেহাই পায়নি ওদের আক্রমণ থেকে। পবিত্র কালামের প্রতি পাক সেনা ও রাজাকারদের অসন্মান প্রত্যক্ষ করে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়। পাক সেনাদের এই আচরণ ছিল ইসলাম ধর্মের চরম অবমাননা। ধর্মের নামে মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করার এই ঘটনা পাকবাহিনী ও দেশী বিশ্বাসঘাতক রাজাকারদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্য ও প্রতিরোধকে আরো উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করেছিল পরবর্তী সময়ে। সন্ধ্যায় স্থানীয় পীরগাছা প্রাইমারী ইস্কুলের একটা ভাঙ্গা বেঞ্চে বসে পড়ি কয়েকজন। দেহটাকে টেনে চলার ক্ষমতা ছিল না তখন। পাশের বাড়ি থেকে একজন আমাদের পানি খেতে দেয়। পেট ভরে পানি পান করি। হাঁটতে থাকি রঘুনাথপুর গ্রামের দিকে। প্রচণ্ড ক্ষুধায় আগুনের মতো জ্বলছিল পেট। সন্ধ্যার গাঢ় অমানিশার মাঝে যুদ্ধক্লান্ত আমরা ক’জন। চারপাশে আঁধারের পর্দা নেমে আসে। অন্যদিন হলে লোকজন হতো খাবার নিয়ে আসতো। আজ সবাই জীবন নিয়ে পালাচ্ছে।
[৬] আব্দুল আজিজ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত