You dont have javascript enabled! Please enable it!

হেমায়েত বাহিনী

গোপালগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন, বীরবিক্রম মুক্তিযোদ্ধে বিশষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি নিজস্বভাবে নিজ এলাকায় গড়ে তোলেন একটি বিরাট বাহিনী। নিজের নাম অনুসারে তাঁর গড়া বাহিনী হেমায়েত বাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে। এই বাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্র ছিল গোপালগঞ্জে, বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ ব্যাপক এলাকা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অনেকগুলি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বহু পাকসেনা, রাজাকার, আলবদর ও তাদের সহযোগীদের হত্যা করেন। হেময়েত উদ্দিন বীর বিক্রম পদ্মার ওপারের এক বিরাট অংশ মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতাপৃর্ণ ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ সরকারের নিক্ট থেকে বীর বিক্রম খেতাব লাভ করেন।
হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রম তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অধীনে সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত ছিলেন। সেনাবাহিনীতে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন হাবিলদার ছিলেন হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রম। সেনাবাহিনীতে চাকরি করা অবস্থায়ই তিনি লক্ষ্য করেন বাঙালিদের প্রতি চরম বিদ্বেষপৃর্ণ একপেশে সরকারি নীতি, পাকিস্তানী সরকারের অত্যাচার, অনাচার ইত্যাদি, যা তাকে পাক সরকারের প্রতি ক্রমাগতভাবে বিষিয়ে তোলে। তিনি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন পকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করার। আর এই সুযোগ পান বঙ্গবন্ধুর আহবান পাওয়ার পর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযোদ্ধের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যখন বাঙালিদের উপর আক্রমণ চালায় তখন হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রম ঢাকার অদূরে জয়দেবপুর সেনা ছাউনিতে ছিলেন। সেখানে অবস্থানরত বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখনও পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। হেমায়েত উদ্দিন যুদ্ধ শুরু হলে বেশ কিছু বাঙালি সৈনিক সঙ্গে নিয়ে জয়পুরদেব ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে আসেন। তিনি বহু কষ্ট করে প্রায় ১মাস পরে ২৬ এপ্রিল নিজ গ্রামে উপস্থিত হন। সেখানে অবস্থান করেই গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট সংগঠন, যা হেমায়েত বাহিনী নামে পরিচিত।
সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণভাবে গড়ে উঠেছিল হেমায়েত বাহিনী। এ বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ছিল ৫০৫৪ জন। তাদের মধ্যে নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীর লোক ছিল ৩৪০ জন। এদের সাহায্যেই হেমায়েত কোটালীপাড়া থানার জহুরের কান্দি হাই স্কুলে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলেন এবং তিন মাসে প্রায় চার হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ দান করা হয়।
হেমায়েত বাহিনীতে বেশ কিছু মহিলা মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। আশালতা বৈদ্যের নেতৃত্বে ৪টি দলে ৪৫জন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এ সমস্ত মহিলা মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়ে রাইফেল, মেশিনগানসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র চালানো শেখেন। তাদেরকে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আশালতা বৈদ্যসহ বেশ কয়েকজন পাকসেনাদের সঙ্গে সরাসরি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নাসিং প্রসশিক্ষণ দেয়া হয়। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য কোটালীপাড়া নারকেল বাড়ির চার্চ মিশন-এ একটি সংক্ষিপ্ত নার্সিং কেন্দ্রও খোলা হয়েছিল। সেখানে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি হাসপাতালও পরিচালনা করা হতো। হেমায়েত বাহিনীতে গরিব শ্রেণীর মুক্তিযোদ্ধাদের বেতনের ব্যবস্থা করেছিলেন হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রম। পিতা-মাতা বা সংসারের জন্য মাসিক ৯৫ টাকা হিসেবে বেতন দিতেন। এতে বহু গরিব মুক্তিযোদ্ধার পরিবার উপকৃত হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে হেমায়েত বাহিনী ছিল ছিল সম্পূর্ণভাবে অভ্যন্তরীণভাবে গড়ে ওঠা একটা সংগঠন। এদের অস্ত্রশস্ত্রের বেশির ভাগই ছিল পাকবাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া। তারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অনেকগুলি সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন। এই বিরাট সাফল্য মূলত হেমায়েত উদ্দিনের নিষ্ঠা এবং তার সঙ্গীদের দায়িত্ববোধ, আন্তরিকতা ও আনুগত্যের ফলেই সম্ভব হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এ ধরণের একক প্রচেষ্টায় অভ্যন্তরীণভাবে গড়ে ওঠা বাহিনীর সংখ্যা মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি।
[২৬৩] তপন শিকদার

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!