হেমু আক্রমণ ও দখল, তামাবিল, সিলেট
[অংশগ্রহণকারীর বিবরণ]
জন্তাপুর ও দরবস্ত থেকে বিতাড়িত হয়ে পাকিস্তান আর্মি সিলেট শহর ও জৈন্তাপুরের মধ্যবর্তী স্থান হরিপুর ইউনিয়ন হেমু গ্রামে পরবর্তী প্রতিরক্ষায় অবস্থান নেয়। হেমু গ্রামটি সিলেট-তামাবিল রাস্তার পাশেই একটি কাচা রাস্তার পূর্ব-পশ্চিম দিক দিয়ে গ্রামের সংগে সংযুক্ত। গ্রামটি বেশ উঁচু ও সামনে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ যা বর্ষাকালে পানিতে ভর্তি থাকে। গ্রামের উভয় পার্শ্বে কিছু হাওর আছে যাতে প্রায় সারা বছরই পানি থাকে।একটি গ্রামে পাকিস্তানী আর্মি তাদের অবস্থান বেশ সুদৃঢ় ও কঠিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। বস্তুত হেমু ছিল পুরো হরিপুর এলাকা যা তৈল ও গ্যাস ক্ষেত্রের জন্য প্রসিদ্ধ, যা সর্বদা প্রহরায় রাক্ষা দুর্ভেদ্য দুর্গ।
দরবস্ত দখলের পর আমরা দরবস্তের পূর্ব দিকে জৈন্তাপুর-কানাইঘাট রাস্তা অতিক্রম করে সিলেট-তামাবিল রাস্তাকে ডান পাশে রেখে গ্রামের এবং হাওরের মধ্য দিয়ে হরিপুরের উদ্দেশ্যে পায়ে হেটে রওনা দিই। রাস্তায় কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল যেমন ছোট ছোট খাল ও জলাশয়। গুর্খা সৈন্যদের সাতার না জানা একটি বিশেষ অসুবিধা ছিল তাদের পানি বাধা অতিক্রম করতে। এদিকে আমার সহযোদ্ধাদের জন্য এটা কোনো বাধাই ছিল না। আমার প্রায় নির্জন হাওর এলাকা দিয়ে প্রায় সমস্ত দিন পায়ে হেটে ৮/১০ কি.মি. দূরে হরিপুর গ্রামে পৌছে তারিখটা ছিল ১২ নভেম্বর ১৯৭১। আমরা একটি বিরাট পরিত্যক্ত বাড়িতে যাত্রা বিরতি করি। সন্ধ্যায় কোম্পানিগুলো সামান্য বিশ্রাম নেয় এবং রাত ৮টায় আমার কোম্পানির ৬ সহযোদ্ধা যাদের মধ্যে সহযোদ্ধা মাহমুদ হোসেন, দেবেশ রঞ্জন কর, নূরুল হক (নুরাই) ও আর্মি, গুর্খা রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার ও ক্যাপ্টেন জান্ডেসহ প্রায় ১২জনের একদল সৈন্যসহ হেমু গ্রামের পিছনে হরিপুর-চিকনাগুল এরিয়ায় সিলেট-তামাবিল রাস্তার পাশে যাই। লক্ষ্য পাক আর্মি টহলরত কোনো গাড়ি, সৈন্য বা যুদ্ধ সংক্রান্ত কোনো সংবাদ সংগ্রহ। রাত প্রায় ৯টার সময় সিলেটের দিক থেকে একটা জিপ স্বল্প আলো জ্বালিয়ে হরিপুরের দিকে আসতে থাকে। হঠাৎ নীরব যুদ্ধক্ষেত্রে সত্রু সৈন্য ও গাড়ির উপস্থিতিতে আমরা দ্রুত নিজ হাতিয়ার নিয়ে শত্রুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। প্রায় কয়েক মিনিটের মধ্যে জিপটি আমাদের অ্যাম্বুশ স্থলে এসে পড়ে। যথারীতি আমাদের ফায়ারিং-এ জিপটি চাকা এবং গাড়িতে গুলি লাগে। কিন্তু গাড়ির গতি বেশি থাকায় প্রথম গুলির পর জিপের চালক জিপের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তবে যে পরিমাণ গুলি গাড়িতে লাগে তাতে আমরা অনুমান করি যে, নিশ্চয়ই আরোহীরা আহত বা নিহত হয়েছে। আমাদের ধারণা পরে সঠিক প্রমাণিত হয়/ জিপের ড্রাইভার ও সঙ্গের আরও দুই জন আরোহী সৈন্য আহত হয় তবু চালক জীবন-মরণ ঝুকি নিয়ে গাড়িটিকে অনেক সামনে নিয়ে ও সঙ্গীসহ পালাতে সক্ষম হয়। আমরা জীপের পিছন পিছন চলতে থাকি এবং প্রায় ৫০০ মিটার দূরে জিপটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাই। জিপটি ছিল এম-৩৮ আমেরিকান জিপ যার পিছনের ২টি চাকাই গুলি লেগে পাংচার হয়ে গিয়েছিল। জিপের ভেতর আমরা একটি জার্মানির তৈরি বাইওনোকুলার একটি ছোট রেডিও ও যুদ্ধের কিছু ম্যাপ পাই এবং গাড়ির ভিতরে ছিল প্রচুর চাপ চাপ রক্ত। ততক্ষণে পাকিস্তান আর্মির বিভিন্ন প্রতিরক্ষার স্থান থেকে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু হয়ে যায়। হেমুতে অবস্থিত পাকিস্তান আর্মির মনোবল ভেঙ্গে যায় কারণ তারা বুঝতে পারে হেমুর পিছনে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী পোউছে গেছে। অতএব, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং লাইন অব কমিউনিকেশন (–) ভেঙ্গে পড়েছে। তাই পরদিন চোরের আক্রমণে তাদের হেমু থেকে পলায়ন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। শুধু আর্টিলারি শেলিং দিয়ে তারা পিছু হটতে পেরেছিল। হেমুতে বসে আমরা ভারতীয় বেতার বার্তায় জানতে পারি ৮ মাউন্টেইন ডিভিশনের একটি ব্রিগেড সিলেটে আসছে এবং ৫/৪ গুর্খা রাইফেলসকে সিলেট শহরের কাছে চালিবন্দরে হেলিকপ্টার দিয়ে নামানো হয়েছে। আর্টিলারি শেলিং-এ আমার কোম্পানির ২জন মুক্তিযোদ্বা শহীদ হন। আমরা হেমু আক্রমণের পর প্রভূত অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ও রসদ লাভ করি। বস্তুতঃ হেমুতে সামনা সামনি যুদ্ধের চাইতে আর্টিলারি দ্বারা যুদ্ধ বেশি হয়। তাই ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রচুর। পরবর্তীতে সিলেটের পাক বাহিনীর জৈন্তপুর এরিয়ার কোম্পানি কমান্ডার মেজর হামিদ আল্পসমর্পনের পর ঐ জিপের জীবিত যিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেচে যান বলে ঐ রাতের বিশদ বিবরণ দেন, তবে তিনি আহত হন যা ১৭ ডিসেম্বর সকালে আমাদেরকে বলেন। আমি রাধানগর যুদ্ধের পর মেজর শামভায়ারের মধ্যে একটি বিরাট পরিবর্তন দেখতে পাই। তিনি অত্যন্ত অল্প কথা বলা শুরু করেন এবং দাড়ি রাখতে থাকেন। সিলেটে মেজর হামিদের সংগে আল্পসমর্পণের পর কথা বলার সময় বুঝতে পারি তার একটি প্রতিজ্ঞা ছিল যে, যতদিন পাকিস্তান আর্মির অস্তিত একজন মেজরকে তিনি জীবিত বা মৃত ধরতে পারবেন ততদিন তিনি শ্মশ্রুমণ্ডিত থাকবেন। কারণ তার প্রিয় সহযোদ্ধা মেজর এস পি সিং রাধনগর যুদ্ধে প্রাণ হারান।
[৪১] জয়ন্ত কুমার সেন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত