You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.16 | হাঁটুভাঙ্গার যুদ্ধ, নরসিংদী - সংগ্রামের নোটবুক

হাঁটুভাঙ্গার যুদ্ধ, নরসিংদী

স্বাধীনতার যুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের দিনগুলোতে ১৯৭১-এর এপ্রিল মাস থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে দেশের সর্বত্র তাদের রণকৌশলগত পুনর্বিন্যাস করছিল। এরই অংশ হিসেবে নরসিংদী জেলার মূলত ভৈরব-ঢাকা রেলওয়ে লাইন নিরাপদে রাখার জন্য তারা নরসিংদী, রায়পুরা প্রভৃতি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। ভৈরব থেকে নরসিংদী চলাচলের জন্য তারা প্রায়ই এই রেললাইন ব্যবহার করতো। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এমনি একটি পেট্রোল দলকে রায়পুরা থানার অন্তর্গত হাঁটুভাঙ্গা নামক স্থানে ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়। হাঁটুভাঙ্গা এই অপারেশনটি নরসিংদী জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অন্যতম সাফল্যজনক ও বিখ্যাত অপারেশন বলে পরিচিত।
হাঁটুভাঙ্গা রায়পুরা থানার অন্তর্গত। এই যুদ্ধটি ১৬ পেপ্টেম্বর (মতান্তরে সেপ্টেম্বর মাসের যে কোনো একদিন) ১৯৭১ সংঘটিত হয়। হাঁটুভাঙ্গা স্থানটি রায়পুরা থানার সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত।
অপারেশনের পূর্বদিন (খুবসম্ভবত ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১) রায়পুরা সদর থেকে কলোনি মসজিদের ইমাম কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধারা এই তথ্য পান যে পাকিস্তানী বাহিনীর বেশকিছু সৈন্য (আনুমানিক এক কোম্পানি) পরদিন রায়পুরা থেকে নরসিংদী পায়ে হেঁটে যাবে। তখন উক্ত এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ৩নং সেক্টরের ১নং প্লাটুন কমান্ডার নায়েক সুবেদার গফুর লেটাবর ক্যাম্পে হাঁটুভাঙ্গাতে শত্রুকে ফাঁদ পেতে হত্যা করার জন্য পরিকল্পনা করেন। নিয়মিত বাহিনীর এই দলের নেতৃত্বে দেন কর্পোরাল শাহজাহান ( বিমান বাহিনী ) যারা শিবপুর অঞ্চল থেকে অপারেশন এলাকায় আসে। এই দলের সদস্য সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১৫-২০ জন। উক্ত দলের সাথে পরিকল্পনা মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধাদের ৪০/৫০ জনের আর একটি দল ইপিআর হাবিলদার জয়দার আলীর নেতৃত্বে আইরমারা/আমিরাবাদ (হাঁটুভাঙ্গা থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে ) থেকে আপরেশন এলাকেয় থেকে এসে যোগ দেয়। অপারেশনের দিন ( খুব সম্ভবত ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ) আনুমানিক ছয় ঘটিকায় করপোরাল শাহজাহানের গ্রুপ হাঁটুভাঙ্গা এলাকায় খানাবাড়ি রেলস্টেশনে অবস্থান নেয়। অ্যামবুশ এলাকা রেললাইনের উভয় পার্শ্বে হাঁটুভাঙ্গা গ্রাম ও পশ্চিম দিকে খানাবাড়ি রেলওয়ে স্টেশন অবস্থিত। সম্পৃর্ণ এলাকাটি ১.৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। রেললাইনের উভয় পার্শ্বে নিচু ভূমি বিল খালে ঐ সময়ে কিছু স্থানে পানি ছিল। ফাঁদ এলাকার পূব পাশ্বে একটি রেলওয়ে ব্রিজ অবস্থিত ছিল। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক হাবিলদার জয়দর আলীর গ্রুপটি ইসলামপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও মেন্দের কান্দি গ্রামের মাঝে অবস্থান নেয়ার কথা ছিল কিন্তু তারা অ্যমবুশ স্থানে দেরিতে পৌছে। তাই পৃর্ব পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দলটি ফাঁদ অবস্থানে ঢুকে ইসলামপুর বিদ্যালয়ে অবস্থান করেছিল। হাবিলদার জয়দর আলী তার গ্রুপ নিয়ে ইসলামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পূর্বে রেল ব্রিজের উভয় পার্শ্বে আনুমানিক ০৭.৩০ ঘটিকার মধ্যে অবস্থান নেয়। অতঃপর পাকিস্থানীরা পায়ে হেঁটে খানাবাড়ি রেল স্টেশন দিকে যেতে থাকলে কর্পোরাল শাহজাহান ( নিয়মিত বাহিনী ) এর দলটি খানাবাড়ি রেলস্টেশন ও বাঙালি নগর বটগাছ থেকে তাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হতচকিত হয়ে যায় এবং রেল লাইন ধরে আবার পূর্ব দিকে এলোপাথাড়ি দৌড়াতে শুরু করে। অতঃপর তারা যখন রেলওয়ে ব্রিজ এলাকায় আসে তখন হাবিলদার জয়দর আলীর দলটি তাদের রাস্তার উভয় পার্শ্বে থেকে বক্স অ্যামবুশ করে। রাস্তার উভয় পার্শ্ব থেকে মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক ফায়ারের সময় কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয় ও ফায়ারের কিছুটা সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে কিংকর্ত্যবিমূঢ় পাকিস্তানী সেনারা রেললাইনের উভয় পার্শ্বে জমাশয়ে পড়ে যায় ও তাতে আটকে পড়ে। এই ফাদে প্রচুর পাকসেনা গুলিবিদ্ধ হয় ও হতাহত হয়। এহেন পরিস্থিতিতে পার্শ্ববর্তী এলাকার আরও মুক্তিযোদ্ধা এসে ঘটনাস্থলে যোগ দেয়। মুক্তিযোদ্ধা ও জনসধারণ এর পারস্পরিক সহযোগিতায় সম্পূর্ণ পাকিস্তানী দলটি নির্মূল হয় এবং তাদের থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এই অপারেশনটি দুপুর ১৪০০ ঘটিকা পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হয়। উক্ত টহলটির উপর অ্যামবুশ হয়েছীই খবর পেয়ে রায়পুরা থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর একটি দল তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। কিন্তু রায়পুরা থেকে হাটু ভাঙ্গা দূরে হওয়ায় (আনুমানিক ৬ কিলোমিটার) ঘটনাস্থলে পৌছার পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে সরে পড়ে। এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। এই সামরিক অপারেশনে স্থানীয় জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতামূলক অবদান বেশ উল্লেখযোগ্য। এই যুদ্ধে আনুমানিক ২৬-২৮ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ১টি এমজি,৩টি জি-৩ রাইফেল, ৪টি রাইফেল ও ৮টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল উদ্ধার করা হয়। এই অপারেশনের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অনেকাংশে বেড়ে যায় এবং ভৈরব নরসিংদী রেলসড়কে পাকিস্তানীদের চলাচল অনেকাংশে হ্রাস পায়।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত