You dont have javascript enabled! Please enable it!

হাতিবান্ধা পাকিস্তানী কযাম্প আক্রমণ,নীলফামারী

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নীলফামারীর হাতিবান্ধা (০৫০৫,৭৮ফ/৪) অপারেশন ছিল আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা। সমগ্র ৬ নং সেক্টরে এটা ছিল পকিস্তানী বাহিনীর সাথে শক্তি পরীক্ষার সবচেয়ে বড় ঘটনা। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে এই যুদ্ধ শুরু হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ভোর রাতে শুরু হয় গোলাগুলি বিনিময়। সারাদিন গোলাগুলির পর বিকেলে উভয়পক্ষে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার আগে সুবেদার মেজর ফজলুর রহমান তার গ্রুপকে নিয়ে নিঃশব্দে অ্যাডভান্স করে পাকিস্তানীদের ডিফেন্স লাইনের দিকে কয়েকশ গজ নিয়ে যান এবং পজিশন নিয়ে সন্ধ্যার দিকে ফায়ার ওপেন করে দেন। দিশেহারা হয়ে পড়ে পাক হানাদাররা। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন গোটা বাহিনীকে। সামনে অগ্রসররত মুক্তিবাহিনীর গতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে পাকিস্তানীদের পক্ষে। যুদ্ধের পরিস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে চলে আসে সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা ৭-২৫ মিনিটের দিকে পাকিস্তানী আর্টিলারি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে মুক্তিবাহিনীর অগ্রগামী ট্রপগুলোর ওপর ক্ষিপ্রগতিতে গোলা ফেলতে শুরু করে। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান অতি কষ্টে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাহিনীকে রক্ষা করেন। পাকিস্তানী সৈন্যদের শক্তিবৃদ্ধি হয়ে যাওয়ার পরও এবং তাদের দিকে ফায়ার বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও কোনো মুক্তিযোদ্ধা বাঙ্কার ত্যাগ করেননি। কেউ যেন মনোবল না হারায় সে জন্য তিনি একটি বাঙ্কার থেকে আরেকটি বাঙ্কারে যান। বাঙ্কারে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের ভরসা দিয়েছেন, আশায় উদ্দীপ্ত করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডারের কথা রেখেছেন হাতিবান্ধা ফ্রন্টে ২৭ সেপ্টেম্বরের সেই রাতে লড়াই ছিল। মাতৃভূমির জন্য আত্মদানের লড়াই। প্রচুর সমারস্ত্রসহ বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানী বাহিনীর সামনে টিকে থাকাই যেখানে কষ্টকর, সেখানে বীর বিক্রমে লড়াই করে গেল তারা। বাঙ্কারে বসে ডিফেন্স লাইন থেকে হানাদারের প্রত্যেকটি গুলির জবাব দিয়েছে। রাত ৮-২০ মিনিটের দিকে হানাদারদের মুখোমুখি বাঙ্কার থেকে ওয়্যারলেসে সুবেদার ফজলুর রহমান জানালেন যে, তিনি নিজ বাঙ্কারে আহত হয়েছেন। বাকিরা বীর বিক্রমে হানাদারদের সাথে লড়াই করেন। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ওয়্যারলেসে পাল্টা জিঞ্জেস করলেন আঘাত কী ধরনের? সুবেদার মেজর ফজলুর রহমান জবাবে জানালেন ‘সামান্য, আমার ছেলেদের জানতে দিইনি। পেত্যেককে নিজ নিজ বাঙ্কারে থেকে বীরত্বের সাথে খানসেনাদের সাথে লড়ে যেতে বলেছি। আমার আহত হওয়ার খবর তারা যেন না পায়।‘ কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান জেনে নিলেন নিখুঁতভাবে ফ্রন্ট লাইনে কোন স্থানে ফজলুর রহমানের বাঙ্কার। ওই মূহূর্তে ৬০০ গজ পেছনে ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। একজন সহযোদ্ধার কাছে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে মতিউর রহমান সুবেদার ফজলুর রহমান-এর বাঙ্কার অভিমুখে যান। কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান সুবেদার ফজলুর বাঙ্কারের কাছে পৌছে যান। তবে বাঙ্কারে পৌছানোর আগেই নিবে গেল এই বীরের জীবন প্রদীপ। শত্রুর গুলিতে লুটিয়ে পড়েন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। একজন সত্যিকার বীরের মতো লড়াই করে হাতিবান্ধার মাটিতে বুকের সমস্ত তপ্ত রক্ত ঢেলে দিয়ে এই জাতীয় বীর শহীদ হলেন। হাতিবান্ধার বুকে সেই রাতে শহীদ হলেন আরো ছয়জন বাঙালি বীর। আহত হলেন ৩০ জনের বেশি। তবু নোয়ায়নি শির, এক ইঞ্চি পিছু হটেনি বাঙালিরা। একটা বাঙ্কার ছাড়েনি হানাদারকে। হাতিবান্ধায় শহীদ বীরেরা শুয়ে আছে হাইস্কুল প্রাঙ্গণে। রাতে আহতদের পাঠানো হলো বুড়িমারী ফিল্ড হাসপাতালে ও তার পরদিন শিলিগুড়ি আর্মি হাসপাতালে। আরো দু দিন পরে মুক্তিযোদ্ধারা হাতিবান্ধা দখল করে নেয় এবং নয় শ-এর বেশি রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। তাদের কাছে জানা যায় যে হানাদার বাহিনীর গত তিন দিনে বহু নিহত ও শতাধিক আহত হয়। খানসেনারা দুটো ট্রাকে করে তাদের ডেডবডি নিয়ে গেছে বলে রাজাকাররা জানায়।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!