You dont have javascript enabled! Please enable it!

সুতারকান্দি অপারেশন, সিলেট

২৪শে মে সুতারকান্দিতে পাকসেনাদের সঙ্গে এক বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। পাকিস্তানবাহিনীর সি-১৩০ বিমানযোগে সৈন্যবৃদ্ধি ও সেই সঙ্গে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর ক্রমাগত আক্রমণের ফলে মুক্তিবাহিনী পিছু হাটতে বাধ্য হয়। অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের অভাব, সৈন্যসংখ্যার স্বল্পতা, অফিসারের অভাব ইত্যাদি কারণেই সেদিন মুক্তিযোদ্ধদের পিছু হটতে হয়েছে। মুক্তিবাহিনী গোপালগঞ্জ ডিফেন্স ছেড়ে বড়গ্রাম বিওপি এলাকায় নতুন ডিফেন্স গড়ে তোলে। মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্য ছিল পাক্সেনাদের শেওলাঘাট থেকে কুশিয়ারা নদী এলাকাতেই বাধা দেও্যা।এই সময় মুক্তিবাহিনীর আধিপত্য না থাকলেও বিয়ানীবাজার এবং জাকীগঞ্জও মুক্ত ছিল। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকবাহিনীর ৩১ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি শেওলাঘাটে ডিফেন্স নেয়। দ্বিতীয় সপ্তাহে সৈন্যসংখ্যা দ্বিগুণ হয়। মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি বড়গ্রাম থেকে ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে পাকসেনাদের উপর মাঝে মধ্যে আক্রমন করছিল। মে মাসের ২০তারিখে পাকসেনারা কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করতে সমর্থ হয়। ২৩ শে মে। রাত ১১ টা। ক্যাপ্টেন রব তাঁর প্রতিরক্ষা পরিখায় ছিলেন, এমন সময় দু’জন লোক দৌড়ে এসে তাঁকে জানায় এক দল পাকসেনা তাঁদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। ক্যাপ্টেন বর ঘটনার গুরুত্ব উপলদ্ধি করে একটি প্লাটুন শাহবাজপুর (লাতু)রেলওয়ে স্টেশনে পাঠান এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। অন্যান্য সূত্র থেকেও ঘটনার সত্যতা নিরূপন করা হয়। দেখা গেল সত্যিই পাকিস্তানিদের দুটি কোম্পানি সৈন্য মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
২৪ মে, সকাল ৬ টা। পাকসেনাদের দুটি কোম্পানি ক্রমশঃ আরো এগিয়ে আসে। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে আগেই জেনেছিল। ক্যাপ্টেন রব এবং তার বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন। পাকসেনারা রাইফেলের আওতায় আসা মাত্র তিনি গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিলেন। শুরু হয় বৃষ্টির মত গোলাবর্ষণ। পাকসেনারা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়লেও কিছুক্ষণ পরেই আর্টিলারী এবং অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে পালটা আঘাত হানা শুরু করে। পাকসেনাদের দুটি কোম্পানির একটি সুতরারকান্দি অপরটি লামাশাল হয়ে বড়গ্রাম আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী সংখ্যায় মাত্র এক কোম্পানি থাকলেও বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে এমনভাবে প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করে অবস্থান করছিল যে পাকসেনারা কিছুতেই সামনে অগ্রসর হতে পারছিলনা। ঐদিন সকালে ৭ টা ৩০ মিনিটের সময় পাকসেনারা সম্মুখ এবং ডানদিক থেকে আবার হামলা চালায়। বেলা ১০ টা পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী সম্মুখযুদ্ধে নিজ ঘাঁটিতে অটুট থাকে। কিন্তু বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে দেখা গেল মুক্তিবাহিনীর গোলাবারুদ প্রায় শেষ। অথচ কোনদিক থেকে কোন সাহায্যও এলোনা। অবশেষে বাধ্য হয়েই ক্যাপ্টেন রব তাঁর বাহিনী নিয়ে পিছনে সরে গেলেন। বেলা ১২ টার মধ্যে পাকসেনা সমগ্র এলাকাতে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। এই যুদ্ধে ৩৯ জন পাকসেনা নিহত এবং দুইজন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হয়, অপরদিকে দুজন মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে এবং বেশকিছু আহত হয়।
ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে পিছনে সরে এসে ১০ জুন বড়পুঞ্জীতে প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করেন। এই সময় থেকে সেক্টরের প্রতিটি সাব সেক্টর কমান্ডারগণ ব্যাপকভাবে নিজ নিজ এলাকাতে পাকসেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ, এ্যামবুশ, সড়ক-সেতু ধ্বংস ইত্যাদি কর্মকান্ড করতে থাকেন। ক্যাপ্টেন রব যুবক ছেলেদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়াতে লাগলেন। এই সেক্টরের বেশ কয়েকটি লক্ষ্য ঠিক করা হয়। ১. পাকসেনাদের নির্ভাবনায় না থাকতে দিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থিতির খবর জানিয়ে দেওয়া। ২. চা বাগান গুলোকে অকেজো করে দিয়ে পাকিস্তানী অর্থনীতিতে দারুন ভাবে চাপ সৃষ্টি করা। ৩. সড়ক সেতু ধ্বংস করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহজ চলাচলে বাধার সৃষ্টি করা। মুক্তিবাহিনী সমগ্র সেক্টর এলাকাতে প্রাথমিক লক্ষ্য তিনটি সামনে রেখে তাদের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখে। তারা বারইগ্রাম, শ্যাওলা, সদাখার, এবং কাংলী ফেরি ধ্বংস করে দেয়। ফুলতলা, রাজকী, মেওলা, সমনভাগ, পৃথ্বিপাশা, সোনারূপা, চূড়ামণি, হাসনাবাদ, সাগরনীল ইত্যাদি চা বাগান বিনষ্ট করে দেওয়া হয়। ৫। কাজী নেছার উদ্দীন মন্টু পিং মৃত কাজী শফিউদ্দীন।
৬। মৃত নজরুল ইসলাম মন্ডল। সর্বসাং মহেশ্বর পাশা। খুলনা শহর পাকসেনাদের দখলে যাবার পরপরই দৌলতপুর থানার মুক্তিযোদ্ধারা উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহনার্থে ভারতে চলে যায়। জুন একাত্তরের পর থেকে তারা গেরিলা কায়দায় বিভিন্ন স্থানে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালায়। উল্লেখ্য পাক সেনাদের দৌলতপুর থানা দখলের পরপরই দুই সপ্তাহের মধ্যে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। তাদের সহযোগিতায় পাকসেনারা এই এলাকায় ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন ও ধর্ষণ চালায়। এ অবস্থায় অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে ও অন্যত্র আশ্রয় নেয়। এ অবস্থা চলতে থাকে এপ্রিল, ৭১ থেকে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু এর মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ও পাকসেনাদের সাথে সেপ্টেম্বর, ৭১ থেকে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দুটি যুদ্ধ। একটি হল গাজীর হাটের যুদ্ধ অপরটি শিরোমণির যুদ্ধ।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!