You dont have javascript enabled! Please enable it!

সুমাদ্দার ব্রীজের পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধ, মাদারীপুর

৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। মাদারীপুর মহকুমা হেডকোয়ার্টারে যেসব পাকসেনা ছিল, তারা এদিন সকালেই প্রায় ৮ টি ট্রাক ও বাসে এবং একটি সামরিক জীপে করে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সম্ভবত আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে কোন সংকেত পেয়েই তারা এইরকম তল্পিতল্পা গুটিয়ে রওনা হয়েছিল। পাকসেনা ও রাজাকারসহ প্রায় ২০০ শত জন একসঙ্গে রওনা হয়। মাদারীপুরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ৮ ডিসেম্বর তারিখে যাওয়ার সংবাদ তাদের সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত লোকের মারফত পূর্বেই পেয়ে যায়। মাদারীপুর শহরের আশেপাশে মাদারীপুর থানা এফ এফ কমান্ডার খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে প্রায় ৫০০ শত মুক্তিযোদ্ধা তখন ছিল। পাকসেনাদের মাদারীপুর থেকে চলে যাওয়ার খবর পেয়ে নির্দিষ্ট ঐ ৮ ডিসেম্বর রাতেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিলুর রহমান তার দলের কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাদের ঘটকচর ব্রীজে প্রথম আক্রমণের জন্য মোতায়েন করে। অবশিষ্ট সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সুমাদ্দার ব্রিজের তিনদিক থেকে পাকসেনাদের উপর একসঙ্গে আক্রমণের জন্য সুপরিকল্পিত ভাবে ডিফেন্স পজিশন বসায়। পাকসেনা ও রাজাকাররা প্রথমে ঘটকচরের ব্রীজ অতিক্রম করে টেকের হাটের দিকে যাওয়ার জন্য নিকটে এলেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রীজের নিকট আক্রমণের জন্য নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকসেনারা তখন গাড়ি থেকে নেমে পালটা গুলি চালায়। সুমাদ্দার ব্রীজে আক্রমণের জন্য নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারে যে, পাকসেনারা আসছে। তারা তখন খুব সতর্ক হয়ে হানাদার বাহিনীর আগমনের অপেক্ষা করতে থাকে। পাকসেনারা সুমাদ্দার ব্রীজের নিকটবর্তী এসে একটি মালবাহী ট্রাক প্রথমে ব্রীজের উপর দিয়ে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেয়। ট্রাকটি ব্রিজের উপর দিয়ে অগ্রসর হয়ে কিছুদূর এগোতেই মুক্তিযোদ্ধাদের পুতে রাখা মাইন বিস্ফোরিত হয়। মালবাহী ট্রাকটি সেখানেই উলটে পড়ে যায়। আসন্ন বিপদ মনে করে পাকসেনা ও রাজাকাররা সুমাদ্দার ব্রীজের দক্ষিণ দিকে রাজাকারদের তৈরি করা বাংকারে পজিশন নিয়ে ডিফেন্সের জন্য তৈরি হয়। মুক্তিযোদ্ধারাও তখন কালবিলম্ব না করে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের উপর তিনদিক থেকে গুলি বর্ষণ শুরু করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট ৬ টি এল এম জি, ১ টি দুই ইঞ্চি মর্টার, এস এল আর, এস এম জি এবং রাইফেল সহ ২০০ হাতিয়ার ছিল। দু পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। ১০ ডিসেম্বর পাক সেনাদের গুলিতে সারোয়ার হোসেন বাচ্চু নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন। এবং আক্তার হোসেন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের সারেন্ডার করানোর জন্য কৌশল অবলম্বন করে। তারা লাউড স্পীকারের মাধ্যমে পাকসেনাদের বারবার বলছিল ‘তোমরা যদি সারেন্ডার কর, তাহলে তোমাদের পূর্ণ নিরাপত্তা আমরা দেব।’ কিন্তু তারা বিশ্বাস করতে পারছিলনা। তাদের বিশ্বাস স্থাপনের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা মাইকে ঘোষণা দিয়ে খাওয়ার সময় খেতে বলতে এবং নামাযের সময় নামাজ পড়তে বলত। এই নির্দিষ্ট সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের প্রতি কোন গুলি বর্ষণ করত না।
ফলে পাকসেনারা নিরাপত্তা ঘোষণার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধ করে রণে ভঙ্গ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট মেজর খটক ও ক্যাপ্টেন সাঈদসহ ৭০ জন পাকসেনা আত্মসমর্পন করে। যুদ্ধে ১৫ জন পাকসেনা নিহত ও ৫০ জন আহত হয়। তাদের সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। বহু রাজাকার মারা যায়। এবং অবশিষ্টদের লাঞ্চনা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। পাকসেনারা এই যুদ্ধে ৩ ইঞ্চি মর্টার, এইচ এম জি, এম এম জি সহ উন্নত মানের হাতিয়ার ব্যবহার করেছিল।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!