সিরাজকান্দির জাহাজ মারা যুদ্ধ, টাঙ্গাইল
মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর ছিল কাদেরীয়া বাহিনীর অন্যতম ঘাঁটি। উত্তারঞ্চলে হেড কোয়ার্টার। ভূঞাপুর থেকেই সিরাজগঞ্জ,টাঙ্গাইল,কালিহাতী,গোপালপুরসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে রণনীতি পরিচালিত হতো। এখানে থেকেই নৌ-পথে টাঙ্গাইলের অধিকাংশ ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং্যের উদ্দেশ্যে বাহাদুরাবাদ-ফুলছাড়ি ঘাট অতিক্রম করে মানকারচর, মহেন্দ্রগঞ্জ হয়ে ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টার যেতো এবং ট্রেনিং শেষে অস্ত্র ও গোলা-বারুদসহ দেশে প্রত্যাবর্তন করে পাক-হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতো।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটে ভূঞাপুরের অন্তর্গত নিকরাইল ইউনিয়নের মাটিকাটার দক্ষিণ-পশ্চিমে যমুনা নদীর পূর্বপাড়ে সিরাজকান্দি ঘাট নামক স্থানে।যে ঘটনার মাধম্যে সারাদেশ এমনকি সারা বিশ্বের মানুষ সেদিন অবাক বিস্ময়ে জেনেছে ভূঞাপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কোম্পানি কামান্ডার মেজর হাবিবের নেতৃত্বে সেদিন পাক হানাদারদের অস্ত্র ও গোলা-বারুদ বোঝাই জাহাজ দখল,বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলা-বারুদ উদ্ধার শেষে মুক্তিযোদ্ধাগণ কর্তৃক জাহাজে আগুন ধরিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যাকে ‘সিরাজকান্দির জাহাজ মারা যুদ্ধ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। জায়গাটি ‘সিরাজকান্দি জাহাজ মারা ঘাট’ নামেও পরিচিতি লাভ করেছে।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পাক-হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে রংপুর সীমান্ত অঞ্চলে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে ছোট-বড় সাতটি জাহাজে হালকা ও ভারি অস্ত্র এবং গোলা-বারুদ নিয়ে এক ব্যাটেলিয়ান সৈন্যসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের চালান নদীপথে প্রেরণ করে। সামরিক মালবাহী জাহাজ স্কটসহ আরিচা ঘাট অতিক্রম করার পর হতেই জাহাজগুলোর অপর পর্যবেক্ষণ চলছিল। যা পরবর্তীতে হাইকমান্ড মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জানান। জাহাজগুলো যখন ধলেশ্বরী নদীতে ঢুকে মাটি কাটার অদূরে সিরাজকান্দির উত্তর সীমানায় অবস্থান নেয়, তখন দুটো স্কটবোত সিরাজকান্দি ও সিরাজগঞ্জের জলপথে ঘোরাফেরা করতে থাকে।
৯ আগস্ট ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। যমুনা নদীর পূর্ব তীরে ধলেশ্বরী ন্দীর উৎসমুখে হানাদারদের জাহাজগুলো নোঙ্গর করে। পাকিস্তানী জাহাজবহর নোঙ্গর করেছে সংবাদ শুনে কমান্ডার মেজর হাবিব সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে ভূঞাপুর ডাক-বাংলোতে বৈঠক করেন। স্থানীয় বেসামরিক লোকজন জেলে,ভিক্ষুক,ফেরিওয়ালা বেশে গোয়েন্দাগিরি করে নিম্নলিখিত তথ্যগুলো জানান।
১. জাহাজটি পানি কম থাকায় আটকে গেছে।
২.জাহাজে তেল নেই।
৩. জাহাজে বাঙালি সারেং আছে।
৪. জাহাজে বিপুল পরিমাণ হালকা,ভারি অস্ত্র ও গোলা-বারুদ আছে।
৫. জাহাজে এক ব্যাটেলিয়ান পাকিস্তানী সৈন্য আছে।
প্রাপ্ত তথ্যের অপর ভিত্তি করে কমান্ডার মেজর হাবিব,আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম,রেজাউল করিম,সৈয়দ জিয়াউল হক,আব্দুল আলীম তালুকদার, ক্যাপ্টেন মোতাহের আলী মিঞা, আব্দুল হামিদ ভোলাসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে বৈঠক করে তাড়াতাড়ি জাহাজ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
যদিও সিরাজকান্দি থেকে টাঙ্গাইল সদরের দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটার এবং সেখানে ছিল পাকিস্তানী বাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি। প্রচুর সৈন্য, অস্ত্র ও গোলা- বারুদ। নদীর ওপাড়েই সিরাজগঞ্জ। সেখানেও ছিল প্রচুর পাক-হানাদার। ছিল আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলা বারুদ। ঘাটাইল,কালিহাতীতেও পাক-হানাদারদের অবস্থান ছিল সুদৃঢ় তবুও মুক্তিযোদ্ধারা ভীত না হয়ে পাকিস্থানী জাহাজবহরের ওপর হামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। উল্লেখ্য যে , সে সময়ে ভূঞাপুর চৌধুরী বাড়িতে খোরশেদ আলম তালুকদারের একটি প্লাটুন, বাশাইল কাউলজানীর আব্দুল গফুরের একটি প্লাটুন এবং ঢাকার নূরুল ইসলাম ইঞ্জিনিয়ারের এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন।
মেজর হাবিবের পরামর্শে অতিদ্রুত মাটিকাটা থেকে নিকরাইল পর্যন্ত রাস্তার পাশ দিয়ে বাংকার তৈরি করে বিভিন্ন স্থানে অ্যাম্বুস বসিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করা হয়। ১টি দুই ইঞ্চি মর্টার, ২টি এল, এম, জি, চাইনিজ ও ব্রিটিশ রাইফেলসহ ১০ আগস্ট রাতে মেজর হাবিব মাত্র ১৮ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নদীর পাড়ে সুবিধাজনক স্থানে জাহাজবহরের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করেন।
১১ আগস্ট ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ। দুপুর বেলা। মাথার ওপর প্রচণ্ড রৌদ্রতাপ। জাহাজবহর আস্তে আস্তে যমুনা নদীর পৃর্ব তীর ঘেঁষে উত্তম দিকে এগিয়ে চলছিল। ছোট আকারের দুটো এবং বড় আকারের একটি জাহাজ নির্বিঘ্নে চলে গেল। মেজর হাবিব কিছু বললেন না। বহরের দ্বিতীয় জাহাজটি ধীরে ধীরে নদীর পূর্বপাড় ঘেঁষে যেতেই একযোগে গর্জে ওঠে মেজর হাবিব ও তাঁর সহযোদ্ধাদের হতের অস্ত্র। পাক-সেনারাও স্কটবোট থেকে বেশ কয়েকটি গুলি ছোঁড়ে। এমতাবস্তায় পেছনে পরা জাহাজ দু’টো উত্তর দিকে অগ্রসর না হয়ে দক্ষিন দিকে পালিয়ে যায়। সামনের জাহাজ দুটো ও সিরাজগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। আক্রান্ত জাহাজটি মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান থেকে পাঁচ/ছয় শত গজ দূরে ডূবো বালুচরে আটকে যায়। জাহাজ আটকে যাওয়ার সাথে সাথে বেশ কয়েকজন খাসসেনা ছোট ছোট গানবোটে দ্রুত সিরাজগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। জাহাজ থেকে হানাদারদের কোন গুলি আসছে না। ইতোমধ্যে দু’জন নাবিক জাহাজের ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার ভাটি হতে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়। তাদের একজন জাহাজের সারেং গোলাম মোস্তফা। সারেং এর নিকট থেকে মেজর হাবিব জেনে নেন যে, জাহাজে বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলা-বারুদ রয়েছে।অতঃপর মেজর হাবিবের নির্দেশে জাহাজের সারেং গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ জিয়াউল হক, মোতাহের আলী মিঞা ও সামাদ গামা ছোট একটি নৌকাযোগে জাহাজে ওঠেন। জাহাজের নীচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত হাল্কা,ভারী অস্ত্র এবং গোলা-বারুদে ভর্তি। জাহাজের ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ২০/২৫ জন খানসেনার লাশ।
এরপর কমান্ডারের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বেচ্চাসেবকরা ছোট ছোট নৌকাযোগে জাহাজ থেকে অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলা-বারুদ খালাস করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। প্রায় ছয় ঘণ্টা সময়ব্যাপী পাঁচশত স্বেচ্চাসেবক জাহাজের প্রায় ৪০ ভাগ অস্ত্র ও গোলা-বারুদ খালাস করতে পেরেছিল। অতঃপর রাত নয় ঘটিকায় এস, টি, রাজন জাহাজের ট্যাংক থেকে তেল এনে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ বোঝাই এ,ইউ, ইঞ্জিনিয়ার্স এল,সি-৩ নামক জাহাজে তেল ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রচণ্ড শব্দে গোলা-বারুদ ফুটতে থাকে। জাহাজের আগুন দু’দুশো থেকে তিনশত ফুট পর্যন্ত ওপরে ওথা-নামা করছিলো। আগুনের লেলিহান শিখা ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত দেখা যাওয়ায় পাক-হানাদারাও ভীত সস্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল।
কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তর)’স্বাধীন্তা-৭১’গ্রন্থে লিখেছেন, জাহাজের লগবুক ও মুভমেন্ট অর্ডারের হিসেব অনুযায়ী এক লাখ বিশ হাজার বাক্সে প্রায় একুশ কোটি টাকার নানা ধরনের চাইনজ, ব্রিটিশ,ওমার্কিন অস্ত্র-শস্ত্র ছিল। জাহাজের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলা-বারুদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা যা উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। তা নিম্নরূপ-
১. চাইনিজ ৩ ইঞ্চি মর্টার সেল. এক লক্ষ বিশ হাজার।
২.চাইনিজ আড়াই ইঞ্চি মর্টার সেল. দশ হাজার।
৩. ব্রিটিশ ২ইঞ্চি মর্টার সেল. চল্লিশ হাজার।
৪. ৮২ ব্রান্ডার সাইট সেলঃ বারো হাজার।
৫. ৭২ আর. আর. সেলঃ সাত হাজার।
৬. ৬প্রাউন্ডার সেলঃ সাত হাজার।
৭. ১২০ এম.এম. সেলঃ পাঁচ হাজার বাক্স।
৮. চাইনিজ রাইফেলঃ পাঁচশ’টি।
৯. ৩০৩ রাইফেলঃএকশ’টি।
১০. ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেডঃ সত্তর হাজার।
১১. স্মোক গ্রেনেডঃ দশ হাজার।
১২. চাইনিজ এম.জি.দু’টি।
১৩. চাইনিজ ৭.৬২ গুলিঃ দশ লক্ষ।
১৪. চাইনিজ ৭.৬৫ঃদু’লক্ষ।
১৫. ৩০৩ গুলিঃ এক লক্ষ।
১৬. চাইনিজ এম. জি. গুলিঃ পাঁচ হাজার।
জাহাজগুলো পরিচালনার নেতৃত্বে ছিল ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ ও লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ। ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ প্রাণে বেঁচে গেলেও সহকারী কমান্ডার আতাউল্লাহ ও সুবেদার রহিম খান মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে মারা যায়।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত