সালুটিকরের যুদ্ধ, সিলেট
৭ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট নুরুন্নাবীর নেতৃত্বাধীন ৩ ইস্ট বেঙ্গল গণবাহিনী কোম্পানি সিলেট শহরের শত্রুর সর্বশেষ প্রতিরক্ষা অবস্থানের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়তে সক্ষম হন। সালুটিকর বিমানবন্দর ও ফেরিঘাট এলাকার যুদ্ধ সিলেটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ যেখানে মুক্তিবাহিনী বীরত্ব ও শৌর্য প্রদর্শন করেছে। ৫ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর অগ্রগামী দল গোয়াইনঘাট থেকে সালুটিকরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সন্ধ্যায় নদীর পাড় ধরে গাইডদের সহায়তায় আলফা, ইকো,ডেল্টো এবং সর্বশেষ লেফটেন্যান্ট মতিউরের কোম্পানি রওনা হয়। ব্যাটিয়নের রিয়ার রাখার পর গোয়াইনঘাট। ৫ডিসেম্বর রাতে বারোটার দিকে লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবি চাইতাবাড়ি পৌছেন ও স্থানীয় গণবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট রউফের সাথে যোগাযোগ হয়। ৬ডিসেম্বর ভোরের পূর্বে তিনটি কোম্পানি চাইতাবাড়ি,জলুরপাড় ও বেতুরকুল গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করে। প্রতিটি কোম্পানি থেকে একটি দল ৬ডিসেম্বর দুপুরের মধ্যে সালুকটিকর ঘাট ও নদীর দক্ষিণ তীর রেকি সম্পন্ন করে। ৬ডিসেম্বর রাত আটটায় লেফটেন্যান্ট মঞ্জুরের আলফা কোম্পানি সালুক্টিকর ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাত নয়টায় লেফটেন্যান্ট নবী নদীর উত্তর পাড়ে অবস্থিত বন বিভাগের ব্রেস্ট হাউসে অপারেশনাল হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। ৭ ডিসেম্বর দুপুর বারোটায় পাকিস্থানী বাহিনীর আনুমানিক ৩০/৩৫ জনের একটি নিয়মিত পেট্রোল পার্টি ফেরি পার হয়ে নদীর পার তীর ঘেঁষে আলপা কোম্পানির দিকে আসে। মুক্তিবাহিনী এদের ওপর গুলি চালালে ওরা পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর রাত আটটায় সুবেদার বদির নেতৃত্বে একটি প্লাটুন সুরমা নদী অতিক্রম করে নদীর দক্ষিন তীরে তিনটি টিলায় অবস্থান গ্রহন করে। রাতের মধ্যেই মুক্তিবাহিনী বাংকার তৈরি করে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল অগ্রবর্তী শত্রু অবস্থানের আনুমানিক ৪০০/৫০০ গজের মধ্যে। মাঝে একটি মাঠ ছিল। ৮ ডিসেম্বর সকাল নয়টায় পাকিস্থানীরা নদীর তীর ঘেঁষে গড়া তাদের প্রতিরক্ষার প্রথম লাইনে অবস্থান নিতে এলে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান থেকে গুলিবর্ষন করা হয়। মুহূর্তে এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুপুর বারোটায় পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সকল অবস্থানে আর্টিলারি শেলিং করে। দুপুর একটায় পাকিস্তানী বাহিনীর প্রায় ১৫০/১৬০ জন সৈন্য নদীর দক্ষিণে তিনটি টিলার ওপর আক্রমন করে কিন্তু তা ব্যর্থ হয়।এক এক ঘন্টা পর আবার ঐ দিনই শত্রুরা আরো চারটি প্রতিহামলা পরিচালনা করে। শত্রুদের মারাত্মক ও ব্যাপক প্রতিআক্রমণের মুখে লেফটেন্যান্ট নবী ৮ ডিসেম্বর রাতে প্রতিরক্ষার কিছুটা পুনর্বিন্যাস করেন। শত্রুও সারারাত ধরে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে .৯ ডিসেম্বর শত্রুবাহিনী কেনরিপাড় এলাকা হয়ে জলুরপাড় এলাকায় অবস্থিত রিয়ার হেডকোয়ার্টার হামলা চালায় ওনদী অতিক্রমের জন্য উদ্যত হয়। শুরু হয় প্রচন্ড শেলিং। তবুও মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড মোকাবিলায় ন্দী পার হতে ব্যর্থ হয়। ৯ ডিসেম্বর শত্রুর বারংবার আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে ও অবস্থানের পুনর্বিন্যাস করে। ঐ দিন টিলাগুলো দখলের জন্য শত্রু ১০ বার প্রতিহামলার চেষ্টা চালায়। ১০ ডিসেম্বর শত্রু ১০টি অবস্থানে একযোগে আক্রমণ করে ও নদী অতিক্রম করে উত্তর পাড়ে অবস্থান নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ১১ ডিসেম্বর ৩ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন আনোয়ার সালুটিকরে নিজ আলফা কোম্পানিতে যোগদান করেন। ঐ দিন বিকেলে শত্রুরা মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর পেছনে দিক দিয়ে আত্মঘাতী আক্রমণ চালায়। ১২ ডিসেম্বর শত্রুরা আবার প্রতিরক্ষার পেছন দিক আক্রমণ চালায় প্রথমে কিছুটা বিশৃংখলা দেখা দিলেও মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তারা বিতাড়িত হয়। পাকিস্তানী বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৩ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবীকে ছাতক অপারেশনে পাঠানো হয় ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার আক্রমণের দায়িত্ব গ্রহন করেন। শত্রুবাহিনী শত চেষ্টা করেও মুক্তিবাহিনীর অবস্থানকে টলাতে পারেনি। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর সিলেটের পতন হয় ও ১৭ ডিসেম্বর সালুটিকরের পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। অস্ত্রবল এবং সমরশক্তি খাটিয়ে সেদিন তারা সালুটিকর এলাকা দখল করে। কর্নেল রাজ সিং মুক্তিবাহিনীর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে বাংলাদেশ সেনাসদরকে লিখেছিলেন, সালুটিকর ঘাট এলাকায় পাকিস্তানী দুর্ধর্ষ আক্রমণকে যে ভাবে প্রতিহত করেছে ও প্রতিহামলা চালিয়ে নিজেদের অবস্থানগুলোকে পুনরায় সংগঠিত করেছে তা বিস্তারিত বলতে গেলে একটি ইতিহাস সৃষ্টি হবে।“ এই যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও আত্মত্যাগের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত