You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১২ই মার্চ, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ২৮শে ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

লেখা ও রেখার সংগ্রাম

শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীত—শাশ্বত সৃষ্টি-রহস্যের নিঃসীম নীলাকাশে তিনটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের অমোঘ প্রাণ-সমাহার। তিনটি একই সুরে বাঁধা আশ্চর্য দ্যোতনা। এরই মাঝেই বিচিত্র রং-আঁচড়ে বিধৃত আছে সৃষ্টির সমস্ত উদ্দেশ্য আর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের শীতল মাধূর্য।
জীবনের সঙ্গে শিল্পের যোগাযোগ এক নিবিড় প্রাণ কম্পন ও নাড়ীর যোগাযোগ। জীবনের মধুমাটি রসেই সে পুষ্পিত পল্লবিত। সাহিত্যও তাই—সঙ্গীতও তাই।
অনাদি, অনন্ত এদের পরিব্যপ্তি, শাশ্বত এদের আবেদন। আমাদের হাসি-কান্নার নিয়ত পরিবর্তনশীল জীবনও তাই অনন্তের দীপক-মেঘে বাঁধা এক একটি আশ্চর্য শিল্প-প্রকাশ, সাহিত্য যোজনা ও সঙ্গীত মাধুর্য ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবনেই এদের জন্ম, জীবনেই এদের অক্ষয় উৎকর্ষতা লাভ। সুতরাং, জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এরা কখনোই প্রকৃত অনবদ্যতা লাভ করতে পারে না।
তাই প্রত্যেক দেশেই, প্রত্যেক কালেই সার্থক শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতে প্রতিফলিত থাকে এক তীক্ষ্ম ও সতেজ যুগ-চেতনা। আর এজন্যই শিল্পী সাহিত্যিক বা সঙ্গীতজ্ঞের জীবনবোধকেও হতে হয় যুগ সচেতন। এক অর্থে সবাই শিল্পী। আর শিল্পীর সার্থক ও নিপুণ আঁচড়েই নিহিত থাকে জীবনের পথনির্দেশ। আর, এজন্যে পৃথিবীর প্রায় সব সভ্য দেশেই শিল্পীর স্থান শ্রদ্ধার সমুন্নত গৌরব শিখরে। যে দেশের শিল্পী সমাজ যতো জীবন সন্নিহিত ও যুগ-সচেতন, সে দেশের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতিও ততো বেশী প্রতিশ্রুত।
কথাগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদউল্লাহ গত রোববার বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার রজত-জয়ন্তী উৎসবে তার উদ্বোধনী ভাষণে। এক দারুণ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে তিনি বলেন যে, বিগত পঁচিশ বছরে বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির অঙ্গণে এক গৌরবময় অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, সুন্দরের আর শিল্পের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। এদেশের দিগন্তপ্রসারী শ্যামলীমা অপরূপ ঢং-এ বয়ে চলা নদনদীর স্রোতধারা তাদের বুকে বিচিত্র বর্ণের পাল তোলা নৌকা, সাম্পানের সমারোহ, ঘাটে ঘাটে কলসী কাঁখে পল্লীবালাদের আগাগোনা, ধূসর দুপুরে বটের ছায়ায় রাখালের বাঁশরিয়া সুর, আরক্তিম গোধূলী আকাশে নীড়মুখী বলাকার সারি—সবই যেন এক বিরাটশিল্পীর নিপুণ শিল্প আঁচড়।
ঋতুতে ঋতুতে যে দেশের প্রকৃতির রূপ বদলায় নববর্ণে, নব-সজ্জায়, যে দেশের প্রকৃতিতে রয়েছে সুন্দর ও ভয়ালের অপরূপ সংমিশ্রণ—সে দেশের আবহাওয়ায় লালিত পালিত মানুষ যে শিল্পী হবে এতে বিচিত্র কি আছে?
তাই, স্মরণাতীতকাল থেকে এদেশের মানুষ তাদের ভাব, অনুভূতি ও প্রেরণাকে চিরন্তন করে রাখার প্রয়াস পেয়েছে তাদের বিচিত্র শিল্প-সৃষ্টিতে। রেখা ও রঙে, ছন্দে ও লালিত্যে, নৈপুণ্যে ও কারুকার্যে যুগ যুগ ধরে তা’ হয়েছে সমৃদ্ধ। নকশী কাঁথার বিচিত্র তার পল্লীবধূর যে বিরহ-বিধুর বেদনা এবং আশা-কল্পনা রূপ পেয়েছে, মৃৎপাতের বিচিত্র ছন্দে ও রঙে কুশলী শিল্পীর যে অনুভূতি ধরা পড়েছে পুতুলের অপূর্ব গঠনে যে ভাব ও কল্পনা নানা ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়েছে, তার তুলনা কোথায়?
রূপসী বাংলার এই যে সৌন্দর্য সাধনার আবহমান ঐতিহ্যধারা, তা আজ আরো বর্ণাঢ্য ও ঐশ্বর্যমন্ডিত হয়ে ফুটে উঠবে বিশ্ব-ধারার মননশীল সংমিশ্রণে, নবীন বাংলার শিল্পীদের প্রতিভা ও সাধনার যাদুস্পর্শে।
বহু আগে থেকেই আমাদের অনেক সৃজনশীল ও প্রতিভাধর শিল্পীরা বিদেশে যথেষ্ট সম্মান ও সশ্রদ্ধ প্রশংসা অর্জন করে এসেছেন। আজ দেশ স্বাধীন। স্বাধীনতার এক রক্তসূর্য দৃপ্ত শপথের বলিষ্ঠতা নিয়ে আমাদের মাথার উপর জ্বল জ্বল করছে। আমরা স্বভাবতঃই আশা করবো আমাদের শিল্পীরা এখন থেকে আরো বেশী পরিশ্রম করে চরম সাধনায় আত্মনিয়োগ করবেন। তাদের সৃজনশীল প্রতিভা আরো উৎকর্ষতা লাভ করবে এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশ্ব স্বীকৃতির গৌরব শিরোপা প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমাদের তরুণ শিল্পীরা মুক্তি যুদ্ধোত্তরকালে তাদের চিত্র-কলায় যুগ-চেতনার যে দুর্লভ দৃষ্টান্ত রেখেছেন, তা’ সত্যিই সর্বতোভাবে প্রশংসার্হ। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে অঙ্কিত বেশকিছু সংবেদনশীল চিত্র তারা আমাদের উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যায়, অসত্য ও দানবিক শক্তির বিরুদ্ধে তাদের বিক্ষুব্ধ প্রাণানুভূতি অপূর্ব অভিব্যক্তি পেয়েছে তাদের সৃষ্টির দৃষ্টি-পটে।
কিন্তু, আমাদের জাতীয় জীবনে আজ আবার পট-পরিবর্তনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাঙালী যেন তার চিরন্তন মূল্যবোধ হারাতে বসেছে। অন্যায়, হিংসা, সংঘাত ও ভোগ-লিপ্সার ক্রুর দানব আজ আমাদের গ্রাস করতে চলেছে। নানান চক্রান্তে শহীদের তাজা চাপ চাপ রক্ত আজ ম্লান হবার পথে।
একে আঘাত হানতেই হবে। আবার সময় এসেছে বিগত মুক্তি সংগ্রাম আমলের সেই ঐক্য আর মনোবল নিয়ে স্থানে স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তুলে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে। যে শক্তিতে আমরা বাইরের দৃশ্যমান শত্রুকে পরাভূত করেছি, আজ তরাই বলে অন্তরের অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধেও আমাদের জয়ী হতেই হবে।
জাতির সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু যে নতুন সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন, তাকে যথার্থ বাস্তবায়িত করতে দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে আসতে হবে অগ্র সেনানীর ভূমিকা নিয়ে।
তাই রাষ্ট্রপতির উদাত্ত আহ্বানের সঙ্গে আমরাও সুর মিলিয়ে আমাদের শিল্পী ভাইদের খোশ আমদেদ জানাচ্ছি, আসুন আবার আপনাদের মোহন তুলির আঁচড়ে এ দেশের সমস্ত অন্যায় অনাচার, ভোগ লিপ্সা, নিষ্পেষণ আর শোষণের চির সমাধি হয়ে প্রাণে প্রাণে নতুন স্পন্দন আর কলমুখরতা জাগুক। জয় আপনাদের হবেই। কারণ, জাতির প্রাণ নিংড়ানো শুভেচ্ছা আপনাদের পেছনে আছে।

কালো টাকার বিরুদ্ধে সঠিক আইন চাই

কালো টাকার খেল, কালো টাকার তেলেসমাতি, কালো টাকার কেরামতি ইত্যাকার কথাগুলো ইদানীং বড় বেশী শোনা যাচ্ছে—বড় বেশী উচ্চারিত হচ্ছে। বিশেষ করে দেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই এসব কথা তথা কালো টাকার কথা বড় বেশী করে শোনা যাচ্ছে। আর এই কালো টাকার কারসাজিতে স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের অবস্থা—দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা দিনকে দিন অবনতি ঘটতে শুরু করছে—দেশের মানুষ ক্রমাগত দিশেহারা ভাবটা ক্রমাগত যে বেপরোয়া হয়ে উঠবে না, তাও কি নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে। ওয়াকিবহাল মহল, অর্থনৈতিক মহল, বুদ্ধিজীবী মহল, সকলেই আজ দেশবাসীর এহেন মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের জন্যে সবাইর আগে আজ যে ব্যাপারটিকে দায়ী করছেন, তা হলো কালো টাকা। এই কালো টাকার জ্বালায় দেশবাসী আজ অস্থির।
গতকাল পত্রিকান্তরে এই কালো টাকা সম্পর্কে প্রকাশিত এক খবরে টাকার পাহাড় ধুলোয় মিশিয়ে দিতে হলে আগে বৃটিশ আমলে প্রণীত আইনের ফাঁক বন্ধ করার পক্ষে মত প্রকাশ করা হয়। এতে জনগণের রক্ত-চোষা অসাধু ব্যবসায়ীদের দমন করার জন্যে তাদের অন্যায়ভাবে অর্জিত কালো টাকা বাজেয়াপ্ত করার জন্যেও বলা হয়। এই খবরে বলা হয় যে, কিছুদিন আগে সরকার কিছু অসাধু ডিলারের ডিলারশীপ বাতিল করেছেন। তাঁদের সংখ্যা ৯৮১। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যখন একদল অসাধু ব্যবসায়ী, ডিলার অসাধু ব্যবসায়ীদের নগ্ন শোষণে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়, জাতির নাভিশ্বাস উঠার উপক্রম হয়, তখন মাঝে মাঝে সরকার এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তবে ডিলারশীপ বা পারমিট বাতিল করলেও এই অসাধু উপায়ে আয় করা কালো টাকা বাজেয়াপ্ত করার মতো কোনো পদক্ষেপই সরকার গ্রহণ করেননি। ফলে লাইসেন্স বাতিল হলেও জনসাধারণকে শোষণ করে অর্জিত টাকা ভোগ করার পূর্ণ সুযোগই সেই সকল অসাধু ব্যবসায়ীদের থেকে গেছে।
বস্তুতঃ কালো পথে অর্জিত কালো টাকাই যে, আজ সকল নষ্টের মূল কারণ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সামাজিক অশান্তি, নৈতিকতাহানি এবং জীবনের মূল্যবোধ হননের অন্যতম প্রধান কারণ, এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এই কালো টাকার হাত থেকে দেশের বর্তমান সাধারণ ও স্বাভাবিক আইন দ্বারা মুক্তি পাওয়াও সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের উপমহাদেশের প্রায় সকল আইনই বৃটিশ শাসনকালে প্রণীত। এই আইন সে সময়ের জন্য উপযোগী থাকলেও আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবং ক্রমবিবর্তনমুখী বিশ্বে একেবারেই অচল। সে কথাও আজ অতি সচেতনতার সাথে অনুধাবন করতে হবে।
তদুপরি আমাদের এই বাংলাদেশ আমরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এমতাবস্থায় একশ্রেণীর লোকের হাতে কেবলই কালো টাকার পাহাড় জমবে—আর দেশের বাকী মানুষ সেই পাহাড়ের নীচে বসে নির্মম শিলাখন্ডের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হবে, এ তো চলতে পারে না—এভাবে তো সমাজতন্ত্রও আসতে পারে না। এটা তো সম্পূর্ণরূপে সমাজতন্ত্রের বিরোধী ব্যবস্থা। এহেন অবস্থায় আগে কালো টাকার পাহাড় ভাঙ্গার জন্যে সঠিক ও সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন অপরিহার্য বলে আমরা বিশ্বাস করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!