লালমোহন থানা আক্রমণ, ভোলা
মুক্তিযুদ্ধকালীন লালমোহন থানা ছিল রাজাকার, আল বদর, আলশামস ও তাদের দোসর দের নিয়ন্ত্রণে। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে লালমোহনের মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহন ও যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করেন। পহেলা রমজান, বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে সেহরী খাওয়ার পর ভোলার সর্বত্রই যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী জনাব সিদ্দিক কমান্ডারের নেতৃত্বে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ ভোলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত প্রায় এক থেকে দেড়শ জনের একদল মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে লালমোহন থানা ঘিরে ফেলে। সিদ্দিক কমান্ডার প্রায় ৮/১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আরসিও অফিসের দিকে অবস্থান নেন। ঐ স্থান থেকে তিনি নিজেই থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম থানায় শত্রুদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। মুহুর্তের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য দলগুলো চতুর্দিক থেকে থানার দিকে গুলি ছুড়তে থাকে। শত্রুপক্ষও থানা থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। তখনকার লালমোহন থানার ওসি মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি পাক দোসরদের থানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করে ব্যররথ হয়ে প্রথমে আবু সওদাগর বাড়িতে গিয়ে অবস্থান নেন। থানার ওসি ফিরে না আসায় তখনকার সালাম দারোগা (বাড়ি নোয়াখালী) থানার নিয়ন্ত্রণ গ্রহন করেন। থানার নিয়ন্ত্রণ গ্রহন করেই ঘোষণা দেন- “জীবন থাকতে সারেন্ডার করব না এবং থানাও ত্যাগ করব না।” এদিকে মুক্তিবাহিনী মাইকিংয়ের মাধ্যমে থানায় অবস্থানকারী শত্রুপক্ষকে সারেন্ডার করার অনুরোধ করেই যাচ্ছে। এছাড়া ওয়েস্টার্ন পাড়ার মোহাদ্দেস সাহেবদের বাড়ির শফিকুল ইসলামের মা লালমোহন বাজারে এসে মাইক দিয়ে তার ছেলেসহ রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সকল সদস্যদের সারেন্ডার করার অনুরোধ করে, তিনি বলেন যে, “বাবা নূর ইসলাম, আমি তোমার মা বলছি। লালমোহনের মুক্তিযোদ্ধাদের আহবানে সাড়া দিয়ে তোমার বাহিনীকে নিয়ে সারেন্ডার কর। এবং তাঁদের পাশে থেকে দেশের স্বাধীনতায় সহযোগিতা কর। মনে রেখ, তোমরা সকলেই লালমোহনের সন্তান। আমি বারবার তোমাকে অনুরোধ করছি। আর যদি তোমরা আমার অনুরোধ না রক্ষা না করো, তাহলে মুক্তিবাহিনী কেরোসিন তেল দিয়ে থানা জ্বালিয়ে দেবে। এতে তোমার মৃত্যু হলে আমার কোন দুঃখ থাকবেনা। আমি তোমাকে ত্যাজ্য করলাম।” এর কিছুক্ষণ পর থানায় অবস্থানকারী তজুমুদ্দিন নিবাসী গোলাম মওলার পিতা এসে তার পুত্রকে একইরকম অনুরোধ করেন। একই সময়ে লালমোহনের শান্তিকমিটির চেয়্যারম্যান জনাব মোহাদ্দেস সাহেবও শত্রুপক্ষকে সারেন্ডারের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু কিছুতেই শত্রুপক্ষ আত্মসমর্পন করতে রাজি হচ্ছেনা। বরং দুপুরের দিকে গুলি পালটা গুলির পরিমান বেড়ে গেল। গোলাগুলির এক পর্যায়ে থানা থেকে ধেয়ে আসা রাজাকার বাহিনীর গুলিতে মনাপাল, বর্তমান ২ নং ওয়ার্ড, লালমোহন পৌরসভার বাগানবাড়ির স্থানে গুলিবিদ্ধ হন। প্রায় দুইঘন্টা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে মনাপাল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দুপুর শেষে আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে উত্তর বাজার জামে মসজিদের পাশে ধোপা সুনীলের ঘরের সামনে মনাপালের মত একইভাবে গুলিবিদ্ধ হন মকবুল খনকার (চরভূতা)। এর কিছুক্ষণ পর একই রকম ঘটনায় লালমোহন ডাকবাংলো ব্রিজের উপর গুলিবিদ্ধ হন রাধারমন কুন্ডু। প্রায় তিন ঘন্টার মৃত্যুর সাথে লড়াই করে দুজনেই পরাজিত হন। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। দুপুরের পর মুক্তিবাহিনী বৃষ্টির মত গুলি ছুড়তে থাকে নানান দিক থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে রাজাকার বাহিনী থানার মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ সময় তাদের খেদমতে থাকা ছেলেটি গুলিবিদ্ধ হয়ে থানার মধ্যে মারা যায়। ফলে রাজাকার বাহিনী আরো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া মুক্তিবাহিনী ঘোষণা দেয় যে, দিনের মধ্যেই আত্মসমর্পন না করলে শেষ রাতের দিকে আগুণ দিয়ে পুরো থানা জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। ভয়ে বিকেলেই রাজাকাররা আত্মসমর্পন করে। অবশেষে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক জনাব মোখলেসুর রহমান দুঃসাহসিকতার প্রমাণ দিয়ে থানায় প্রবেশ করেন। একই সাথে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের প[অতাকা উত্তোলন করেন। পরক্ষণেই সকল মুক্তিযোদ্ধা থানায় একত্রিত হয়ে জনাব মোতাহার উদ্দিন মাস্টার ও জনাব মোখলেসুর রহমানের নেতৃত্বে লালমোহন থানাকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করেন।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত