You dont have javascript enabled! Please enable it!

শঠিবাড়ির যুদ্ধ, রংপুর

রংপুর জেলা সদরবর্তীএকটি উপজেলা কাউনিয়া। এই উপজেলাতেই বিখ্যাত তিস্তা নদী। পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহমান তিস্তার গা ঘেঁষে শঠিবাড়ি বন্দরের অবস্থান। তিস্তার গড় প্রশস্ততা শঠিবাড়ি বন্দরের সামনে ছিল প্রায় ৪০০ গজ। পাকবাহিনী সিমেন্টের তৈরি বাঙ্কারে নিজেদের প্রতিরক্ষাকে ছয়মাস যাবত শক্তিশালী করে রেখেছিল এবং তাদের ধারণা ছিল যে, মুক্তিবাহিনী আদৌ তাদের প্রতিরক্ষা মোকাবেলা করতে সক্ষম নয়। মুক্তিবাহিনীর অদম্য সাহস, বুদ্ধিমত্তা এবং সুপরিকল্পনার মাধ্যমে সেপ্টেম্বর বাহিনীর দুই তারিখ পর্যন্ত পাকবাহিনীকে ব্যস্ত রাখে। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা হড়ে তোলে পাকা সিমেন্টের বাঙ্কার। শঠিবাড়ি বন্দরের পূর্ব ও উত্তর দিকে পাক হানাদারদের এক হাজার গজ দূরে এইসব বাঙ্কার তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের মনোবল বাড়িয়ে তোলে। এইসময় মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদাররা তাদের অবস্থান থেকে মাঝে মাঝে গুলি বিনিময় করতে থাকে। সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ রাত ৩টায় কমান্ডার নিজে এস এল আর নিয়ে হানাদার পজিশনে ফায়ার শুরু করে দেন। শুরু হয় মরণপণ যুদ্ধ। হারেসের ছেলেরা প্রতিজ্ঞা করে শঠিবাড়ি বন্দর দখল না করে তারা পিছু ফিরবেনা। শঠিবাড়ি হাইস্কুলের ভেতরে নির্মিত দুর্ভেদ্য ঘাঁটি থেকে সেল বর্ষণ করে খান সেনারা। শুরু হল তুমুল যুদ্ধ। খান সেনাদের মুহুর্মুহু সেল ও রকেটের আঘাত এসে পড়েছিল মুক্তিবাহিনীর উপর। ভাঙছে বাঙ্কার, আহত হচ্ছে মুক্তিসেনা। ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে পিছনে। গোলাগুলি আর আর্তনাদে ভরে উঠল ডিমলা থানার শঠিবাড়ি বন্দর। সমান গতিতে যুদ্ধ চলছে। ঘন্টার পর ঘন্টা। কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটছেনা। একদিকে কমান্ড করছেন হানাদার বাহিনীর দুর্ধর্ষ মেজর হায়াত। অন্যদিকে শ্যামল বাংলার এক তরুন বীর হারেস উদ্দিন সরকার। এক বাহিনী ছুড়ছে কামানের গোলা, রকেট ও শেল। অন্যবাহিনী দুয়েকটি এল এম জি আর থ্রি নট থ্রি দিয়ে তার জবাব দিচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যাচ্ছে। ৪ তারিখ শনিবার সকাল থেকে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গেল। হারেসউদ্দিন সরকার কয়েকজন সাহসী সাথীকে নিয়ে পরপর কয়েকটি সম্মুখের বাঙ্কার পার হয়ে অগ্রসর হয়ে গেল সামনের দিকে। হানল এল এম জির নিখুঁত আঘাত। হানাদার বাহিনীর প্রধান অবস্থান শঠিবাড়ী স্কুলের ভেতরের বাঙ্কারে। দুপুর বারোটার দিকে চাঞ্চল্য দেখা গেল হানাদারদের বাঙ্কারে ও প্রতিরক্ষা অবস্থানে। দ্বিগুণ শক্তিতে হারেসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ছুটে যেতে লাগল সম্মুখপানে। সে এক ঐতিহাসিক মূহুর্ত। শঠিবাড়ী বন্দর আর কয়েক মিনিটের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের করায়ত্ত হবে। প্রতিটি বাঙ্কারের মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদের ফায়ার করে ব্যস্ত রাখছে। হানাদার বাহিনী তাদের প্রতিরক্ষা লাইন ছেড়ে পেছনে হটে যাচ্ছে। হারেস ও তার বাহিনী বুকে থ্রি নট থ্রি চেপে ধরে সম্মুখপানে গড়িয়ে গড়িয়ে দখল করছে সামনের ভূমি। মরিয়া হয়ে টিপে যাচ্ছে থ্রি নট থ্রির ট্রিগার। জয় তারা ছিনিয়ে আনবেই। হানাদারদের পালাতে হবে শঠিবাড়ী থেকে। সুপ্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনী তাজ্জব বনে গেল। এক তরুন মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডে এগিয়ে আসছে থ্রি নট থ্রি হাতে বাঙালি তরুন বালক। অব্যররথ গুলি ছুঁড়ছে তাদের বাঙ্কারে। ছেড়ে যেতে হচ্ছে তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান। ৪ সেপ্টেম্বর সূর্য ডোবার আগেই শঠিবাড়ী বন্দর মুক্ত হয়ে যাবে, এই কথা কোম্পানী কমান্ডার হারেসউদ্দিন ঘোষণা করে দিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা গুলি চালিয়ে যাচ্ছে হানাদারদের প্রত্যেকটা বাঙ্কারে। শঠিবাড়ী বন্দর জয় করলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ৪ সেপ্টেম্বর শঠিবাড়ি বন্দরে যখন মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, পূর্ব গননে সূর্য যখন ঢলে পড়েছে ঠিক তেমন সময়ে গর্জন করতে করতে এলো দুটি হেলিকপ্টার। হারেসউদ্দিন ও তার বাহিনীর বাঙ্কারের পজিশনে বৃষ্টির মত বোমা ফেলল তারা। আক্রোশে, ক্ষোভে মুক্তিযোদ্ধারা এল এম জির ফায়ার করল। হেলিকপ্টার দুটো চলে গেল প্রায় দুঘন্টা ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন পজিশনে বোমা বর্ষণ করে। ডান পায়ে এবং ডান হাতে এবং কপালে বোমার আঘাতে আহত হলেন সেই বীর তরুন হারেসউদ্দিন, যিনি ছিলেন সেই তিনশো পনেরো জন মুক্তিযোদ্ধার বীর নায়ক। আহত হলো আরো অনেকে। নিমিষেই নিভে গেল সেই মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ের আশা। রক্তাক্ত, ক্ষত বিক্ষত, আহতদের ব্যান্ডেজ ও ফার্স্ট এইড শুরু হল। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ৬ নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারের সাথে সকল যোগাযোগ। খাবার ও অন্যান্য সামগ্রীর উপর বোমা পড়ায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল। যদিও অস্ত্র এবং গোলাবারুদের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কার এবং ডিফেন্স থেকে গুলি বন্ধ হওয়ায় হানাদার বাহিনী শুরু করল নতুন উদ্যমে গুলিবর্ষণ। ৪ সেপ্টেম্বর রাতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা যখন হতাশ হয়ে পড়ছিল তখন রক্তাপ্লুত কোম্পানী কমান্ডার চিৎকার করে বললেন, ‘যুদ্ধ চলবে, মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে।’ কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবেনা। কাউকে যদি পিছনে তাকাতে দেখি, এই আহত অবস্থায় আমি তার উপর গুলি চালাব। জন্মভূমির বুকে বীরের মতো লড়ে প্রাণ দাও সবাই। হেড কোয়ার্টার থেকে আমরা তিনশ জন বিচ্ছিন্ন, বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। ধরে ভনাও আমরা সবাই মরে গেছি। তিনি সবাইকে অনুরোধ করে বললেন, ‘মৃত্যুর আগে একবার শেষ লড়াই লড়ে যাও। মুখে কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু তুলে এসো মা কে মুক্ত করার জন্য আমরা এখানে মরে যাই।’ মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ ফিরে পেলেন। আবার ফিরে গেলেন বাঙ্কারে। হাতে তুলে নিলেন থ্রি নট থ্রি। এমনিভাবে পার হয়ে গেল ৪ তারিখ রাত। ৫ সেপ্টেম্বর তারিখে সারাদিন যুদ্ধ চলল। সন্ধ্যায় দুইপক্ষেই ফায়ার বন্ধ হল। সারারাত আহতদের সেবা শুশ্রুষা চলল। ৬ সেপ্টেম্বর তারিখ ভোরে হানাদার বাহিনী ৬ ইঞ্চি মর্টার ও রকেট লঞ্চার দিয়ে তুমুল আক্রমণ শুরু করল। একদিকে খাবার নেই। আড়াইদিন পার হয়ে যাচ্ছে। শুধু পানি খেয়ে ও লতাপাতা চিবিয়ে বেঁচে আছেন তিনশ পনেরো জন মুক্তিযোদ্ধা। শুধু ব্যান্ডেজ বেঁধে আহতরা পড়ে আছেন বাঙ্কারে। সামনের দিক থেকে ছুটে আসছে পাকিস্তানি কামানের গোলা, মেশিনগানের গুলি। সবকিছু অনিশ্চিত। সবদিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন। তবু মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই চালিয়ে গেলেন। সবকিছু অনিশ্চিত জেনেও জীবন বাজি রেখে লড়ে গেলেন শঠিবাড়ী বন্দরে। ৬ তারিখ রাত আটটায় শঠিবাড়ির ডানদিকের মুক্তিযোদ্ধারা আকস্মিকভাবে তিনশ গজ ছুটে গিয়ে হানাদারদের কয়েকটি প্রতিরক্ষা অবস্থান দখল করে নেন। এটা ছিল একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ। সেই প্রতিরক্ষা লাইনে ছিল প্রায় দেড়শ রাজাকার। তারা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করে। আহত কোম্পানী কমান্ডারের নির্দেশ মোতাবেক রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রন্ট লাইনে বসিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর আদেশ দেওয়া হয়। ধৃত রাজাকাররা সে আদেশ পালন করল। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়। চাঙা হয়ে ওঠেন তাঁরা। ৬ সেপ্টেম্বর সারারাত গুলি আর পালটা গুলি চলতে থাকে। ৭ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা পাকবাহিনী অবস্থান ত্যাগ করে নীলফামারীর দিকে পালিয়ে যায়। ৭ সেপ্টেম্বর সকাল ৭ টা ২০ মিনিটে শঠিবাড়ী বন্দরে উঠল মুক্তির পতাকা।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!