You dont have javascript enabled! Please enable it!

শমসের নগর চা বাগান অভিযান, মৌলভীবাজার

মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত কমলগঞ্জ থানা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার পূর্বে শমসের নগর এলাকা ছিল পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি। শমসের নগর শহরের সাথেই চা বাগান। চা কারখানাটিও একেবারে শহরের সাথেই। অক্টোবর মাসের শেষভাগে কৈলাশহর সাব সেক্টরে শমসের নগর চা কারখানায় একটি অপারেশন পরিচালনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। শমসের নগর আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর শক্ত প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করে শত্রু ক্যাম্পের একেবারে পাশে একটি অপারেশন করে শত্রুর গোটা নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে ঝাঁকুনি দেওয়া এবং সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে মুক্তিবাহিনী ন্সম্পর্কে একটি ত্রাস সৃষ্টি করা। চাতলাপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান। ঐ অবস্থান অতিক্রম করেই বাগানে ঢুকতে হয়। পাশাপাশি শমসের নগরের কাছাকাছি বলে কাজটি বিরাট ঝুঁকিপূর্ণও। এ অপারেশনের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় লেফটেন্যান্ট আলী ওয়াকিউজ্জামানকে। তাঁর সহকারী হিসেবে ছিলেন সুবেদার শামসুল হক ও নায়েক মনির।, সাথে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা। লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জামান প্রথমেই টার্গেট ও যাওয়া আসার রাস্তা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। উপযুক্ত পথপ্রদর্শকও যোগাড় করা হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জামান তার পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাছাই করা ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়। গোটা দলটিকে ১০ জনের দুটি গ্রুপে লেফটেন্যান্ট ওয়াকি ও সুবেদার সামসুর নেতৃত্বে ভাগ করা হয়। ২৫ অক্টোবর রাত ১২ টার পর কৈলাশহর ক্যাম্প থেকে মুক্তিবাহিনীর গ্রুপটি রওনা হয়। সোজা পথে না গিয়ে তারা চাতলাপুর সীমান্ত ফাঁড়ির পাশে অবস্থান নিলেন প্রথমে। এখানে পাকিস্তানী বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান ছিল। বাগানের সকল রাস্তা তাদের মিয়ন্ত্রণে। ২৪ ঘন্টা পাহারার ব্যবস্থা রয়েছে। কোনমতেই সদর রাস্তায় ওঠা যাবেনা। তাই আগে থেকে নির্ধারিত বিকল্প পথে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জামান। এই বিকল্প পথটা ছিল খুবই দুর্গম তার উপর ছিল চাঁদনী রাত, তাই পাহাড়ের উপর দিয়ে যাওয়া যাচ্ছিলনা। বাধ্য হয়েই মুক্তিবাহিনী পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বুকসমান পানি আর কাদা ভেঙে এগিয়ে চললেন। দলটি যখন বাগানে প্রবেশ করে তখন রাত আড়াইটা। ৭/৮ মাসের অযত্ন অবহেলায় চা গাছগুলো যথেষ্ট বড় বড় হয়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে আগাছা। অবশ্য এসব আগাছা সহায়ক হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এই অভিযানেগাছগুলোর নিচে দিয়ে অবাধে যাতায়াত করতে সমর্থ হয়েছেন তাঁরা। চা বাগানের ভেতরে ঢুকেই পরিকল্পনা অনুযায়ী দলটি বিভক্ত হয় দুভাগে। লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জামানের নেতৃত্বে একটি দল ধোকে কারখানায়। সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে বাকি ১০ জনের গ্রুপটি পাকিস্তানি বাহিনীর বাইরে থেকে পরিচালিত আক্রমণ প্রতিহত করতে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান গ্রহন করে। সার্চ লাইট দিয়ে সমস্ত বাগানকে আলোকিত করে রাখা হয়েছে। তাই অতি সাবধানে অগ্রসর হতে হল সবাইকে। কারখানার পিছনে কিছু গাড়ি ছিল। এগুলো দিয়েই পাকিস্তানি বাহিনীর খাদ্য রসদ পরিবহন করত। নিজেদের যাতায়াতেও ব্যবহার করত এইসব গাড়ি। তাই ট্রাকগুলোও ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। নায়েক মনির ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গাড়িগুলি ধ্বংস করতে যান। লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জামান ঢোকেন কারখানার ভিতরে। ত্বরিত গতিতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিস্ফোরক দ্রব্য স্থাপন করা হল। মনিরও দুইটি ট্রাকে এ সময় বিস্ফোরক সংযোগ করতে সমর্থ হন। নির্ধারিত সময়ে দুজনই অগ্নিসংযোগ করেন। রাত তখন চারটা। প্রচন্ড শব্দে উড়ে গেল কারখানার জেনারেটর এবং দুটি ট্রাক। একইসাথে কভারিং পার্টি শুরু করে গোলাবর্ষণ। ১০ মিনিটের মধ্যেই অ্যাকশন পার্টি একটি নিরাপদ দূরত্বে এসে অবস্থান নেয়। তারপর পুরো দল পূর্ব আকাশে সূর্য ওঠার সাথে সাথেই ক্যাম্পে এসে পৌঁছাতে সমর্থ হয়। কারখানার যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!