You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.13 | লক্ষ্মীপুর অ্যামবুশ, ময়মনসিংহ - সংগ্রামের নোটবুক

লক্ষ্মীপুর অ্যামবুশ, ময়মনসিংহ

লক্ষ্মীপুর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত ফুলবাড়িয়া থানার অধীন একটি একটি গ্রাম। ময়মনসিংহ শহর থেকে ফুলবাড়িয়া থানা সদরের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। ফুলবাড়িয়া থানা সদর থেকে লক্ষ্মীপুর ও রাঙামাটি গ্রামের দূরত্ব যথাক্রমে ৫ এবং ৭ কিলোমিটার। লক্ষ্মীপুর গ্রামটি টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর গড়ের কাছাকাছি। ময়মনসিংহ শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং রেঞ্জার্স সৈন্যের অবস্থান ছিল। শহরে অবস্থানরত সেনাবাহিনী সরাসরি পার্শ্ববর্তী এলাকার নিরাপত্তার দ্বায়িত্ব পালন করত। প্রায় প্রতিদিন সেনা সদস্যদের একটি টহল দল ফুলবাড়িয়া থানা এলাকায় পাঠানো হত। এই সেনাদল সাধারণত সারাদিন অবস্থানের পর সন্ধ্যায় ময়মনসিং ফিরে আসত। ফুলবাড়িয়া থানা ছিল ৩৩ পাঞ্জাব ও ৭০ উইং রেঞ্জার্সের অপারেশনাল এলাকার নিয়ন্ত্রণাধীন। লক্ষ্মীপুর গ্রাম এবং ফুলবাড়িয়া থানা এলাকায় প্রাথমিক অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের কোন স্থায়ী ঘাঁটি ছিলনা। মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত ঘাঁটি থেকে বিভিন্ন সময় পাক বাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের উপর আক্রমণ পরিচালিত হত। ফুলবাড়িয়া থানা এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়মিত টহল দানের সংবাদটি মুক্তিযোদ্ধাদের নজরে আসে। গ্রাম্য এলাকায় পাক বাহিনীকে আক্রমণ করা সহজতর হবে বিধায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এই টহলদার বাহিনীর ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। পাক বাহিনীর এই দলকে অ্যাম্বুশ করার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত নায়েক এ. কে. মোজাফফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ফুলবাড়িয়া থানা এলাকায় প্রবেশ করে, স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় আত্মগোপনের মাধ্যমে পাকবাহিনীর চলাচলের উপর নজর রেখে আক্রমণের পরিকল্পনা কার্যকর করার চেষ্টা চালাতে থাকে। ১৩ জুলাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি দল গাড়িযোগে ফুলবাড়িয়া থানা এলাকায় টহলে আসে। এই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল ফুলবাড়িয়া থানা থেকে ৪ কিলোমিটার পূর্বে কাটাখালি নামক গ্রামে। সকাল ৮ টায় ট্যাক্সিচালক আসগর আলীর মাধ্যমে পাক বাহিনীর এই আক্রমণের সংবাদ আসে। মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কমান্ডার নায়েক এস কে মোজাফফর রহমান তার সহযোদ্ধাদের সাথে আলোচনার পর পাকবাহিনীর এই কনভয়ের উপর এই আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহন করেন। এই সময় মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে ছিল দুইটি এল এম জি, ৩ টি এস এম জি, ১২ টি রাইফেল এবং বেশকিছু গ্রেনেড। অতি দ্রুত গতিতে মুক্তিযোদ্ধা দলটি কাটাখালি থেকে পায়ে হেঁটে সকাল ৯.৩০ মিনিট নাগাদ লক্ষ্মীপুর বাজারে এসে পৌঁছায়। এদিন লক্ষ্মীপুর ছিল সাপ্তাহিক হাটবার। স্থানীয় জনগণের চলাচল থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান পরিবর্তনে বেশি বেগ পেতে হয়নি। কমান্ডার মোজাফফর রহমান তাঁর দলকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে লক্ষ্মীপুর বাজার এলাকার সুবিধাজনক তিনটি স্তাহ্নে অবস্থান করার নির্দেশ দেন। ২ টি কার্ট অফ পার্টিকে কিছু দূরত্বে রাস্তার দুপাশে অবস্থান নিতে বলেন। প্রত্যেক কার্ট অফ পার্টিতে ১০ জন সদস্য নিয়ে ছনকান্দা এলাকায় অবস্থান গ্রহন করে। আনুমানিক সকাল ১০ টা থেকে সকাল ১০.৩০ টার মধ্যে পাকিস্তান বাহিনীর অগ্রবর্তী ট্রাকটি অফিসারসহ লক্ষ্মীপুর বাজারে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ স্থলের কাছাকাছি পৌঁছানোর সাথে সাথে গাড়ির চাকাকে লক্ষ করে মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর নায়েক বকুল প্রথম দুইটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। গ্রেনেড দুটি ট্রাকের পাশেই বিস্ফোরিত হয়। এই সাথে অপর মুক্রিবাহিনীর সদস্যের গুলিতে পিছনের ট্র্যাকের চাকা ফেটে থেমে যায়। পাকবাহিনী প্রস্তুতি নেবার পূর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে আরো ৭/৮ টি গ্রেনেড ছোড়া হয়। ফলে পাক বাহিনীর প্রতিরোধ প্রস্তুতি অনেকাংশে রুদ্ধ হয়ে পড়ে। রাস্তা ছোট থাকায় গতি ঘুরিয়ে নেওয়া পাকবাহিনীর পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। নায়েক মান্নান তার দল এমজি মূল সড়কের উপর স্থাপন করে সারিবদ্ধ অবস্থানে থাকা গাড়ির উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এই গুলিতে প্রথম ট্র্যাকের সামনে বসা অবস্থায় জনৈক পাকিস্তানী অফিসার জীবন হারায়। সামনের দিকে যাওয়া সম্ভব নয় ভেবে পিছনের গাড়ি থেকে সেনা সদস্যরা পশ্চাদপসরণ করে বেশ কয়েকজন সেনাসদস্য ময়মনসিং হেডকোয়ার্টারে ফিরে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক পাকবাহিনী আক্রান্ত হবার সংবাদ পৌঁছায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১০/১২ টি গাড়ি সৈন্য সহ ঘটনাস্থল লক্ষ্মীপুর বাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পাক বাহিনীর সৈন্যদলের আগমন সংবাদে মুক্তিযোদ্ধারা নিহত পাক সৈন্যদের রাইফেল, গোলাবারুদ ও একটি ওয়ারলেস সেট নিয়ে প্রথমে কাটাখালি গ্রামে এবং পরবর্তীতে কাটাখালি থেকে আরো দক্ষিণে কুতুবখালি বাজারের কাছাকাছি অবস্থান গ্রহন করে। বেলা ১১।৩০ মিনিট নাগাদ পাকবাহিনীর সৈন্যদল লক্ষ্মীপুর পৌঁছে নিরীহ জনগণের উপর নির্মম অত্যাচার শুরু করে। পাকবাহিনী বাজারে আগুন ধরিয়ে দিলে পার্শ্ববর্তী অসংখ্য বাড়ি ভস্মীভূত হয়। এই সময় পাকবাহিনী প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে বাজারের পার্শ্ববর্তী গ্রামের ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত