লাওকোরার যুদ্ধ, চাঁদপুর
মুক্তিযোদ্ধা মুজিব আমাকে লাওকেরার যুদ্ধের বর্ণনা দেন। “২৩-১০-১৯৭১, আমরা আরো দুজন যোদ্ধা শহীদ মোঃ জহির হোসেন, পিতা মৃত-মৌলভী মোহাম্মদ ছালামত উল্লাহ, সাং শমসেরপুর এবং শহীদ মোঃ ইলিয়াস হোসেন, পিতা মৃত- সৈয়দ আব্দুর রাজ্জাক, সাং- আজাগরা, শাহরাস্তি [এই দুজইন চাঁদপুরের লাওকরার যুদ্ধে শহীদ হন] এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ওপি, একজন লেফটেন্যান্ট অফিসার সহ ২০/২৫ জন পাকসেনা খতম হয়। লাওকরা যুদ্ধের ভয়াবহতা ঐ এলাকার জনগণ এখনো ভোলেনি। লাওকরায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত থেমে থেমে যুদ্ধ হয়। আমার লোকজন ছিল লাওকরা মজুমদার বাড়িতে। এই সংবাদ পাকবাহিনীকে কোন দালাল হয়ত জানিয়েছিল। বাড়ির পূর্বদিকে ছোট্ট খাল। পাকবাহিনী যাতে সরাসরি বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য আমার লোকজন বাঁশের সাঁকোটি ফেলে দেয়। উয়ারুক থেকে পাকবাহিনী দুই ভাগ হয়ে পায়ে হেঁটে এবং নৌকায় আসে। পাকবাহিনীর আগমনের খবর শুনে খুব ভোরে আমার লোকজন মজুমদার বাড়ির খাল পাড়ে বাঁশঝাড়ের গোড়ায় ও বাগানে অ্যাম্বুশে ছিল। পাকবাহিনী এসেই আমাদের অতর্কিতে হামলা করে। তাদের অতর্কিত হামলার মুখে আমাদের এল এম জি ম্যান আব্দুল হাকিম মোল্লা হঠাৎ তার সামনে পাকবাহিনী দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ভয়ে আতঙ্কে তিনি এলএমজি ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে পিছে চলে আসেন যা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিরাট ক্ষতি। এই পরিস্থিতিতে উল্কা আবুল খায়ের বীরত্বের পরিচয় দেন। আবুল খায়ের বুঝতে পেরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কমান্ড করেন ফায়ার। তার কমান্ডে সবাই পাকবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণের প্রথম ধকলে পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে টিকে থাকতে না পেতে চতুঈদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাকবাহিনীর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল পজিশন নেবার কোন স্থান তারা পাছিল না। ঝোপঝাড়ে, জঙ্গলে, পানিতে দাঁড়িয়ে যে যেভাবে পারছে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এই যুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে লড়তে গিয়ে আমার দুজন বীর যোদ্ধা শহীদ হলেও উল্কা আবুল খায়ের সবাইকে নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি লড়াই চালিয়ে যান। মজার ব্যাপার শত শত জনতা দূর থেকে দেশী অস্ত্র টেডা (বর্শা), শাবল ইত্যাদি নিয়ে অপেক্ষা করে কখন পাক বাহিনীকে তাজা ধরতে পারবে। পাকবাহিনী যখন বুঝতে পারল তাদের বুলেট শেষ হলে জনতার হাতে নির্মম ভাবে মরতে হবে তখন তারা লড়াইয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিল লাশ সরানোর কাজে। এদিকে আমাদেরও বুলেট প্রায় শেষ তাই আমরাও পজিশনে থেকে মাঝেমাঝে ফায়ার করছি। শেষপর্যন্ত পাকবাহিনী কয়েকটি লাশ রেখে পিছু হাঁটতে বাধ্য হয়।
পাকবাহিনী যাবার সময় লাওকোরা মজুমদার বাড়ির প্রায় সবকয়টি বসতঘর ও পাকের ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এই যুদ্ধে অনেক বেসামরিক লোক মারা যায়। তাঁদের মধ্যেঃ
১. জয়নাল আবদীন মজুমদার -৫৫ বছর ২. ইয়াছিন মজুমদার – ২৫ বছর, ৩. সৈয়দ আব্দুল বাতেন -২৮ বছর, ৪. সৈয়দ আবু তাহের -১৬ বছর, ৫. হাফিজউদ্দিন পাটোয়ারী – ৫৫ বছর ৬. আমীর হোসেন পাটোয়ারো – ৪০ বছর ৭. চাদমিয়া পাটোয়ারী -৩০ বছর, ৮. চাদমিয়া বেপারী – ৪৩ বছর, ৯. সিদ্দিকুর রহমান সরদার -৪৫ বছর, ১০. সোনা মিয়া – ৭৫ বছর, ১১. ফাতেমা – ৫৬ ১২. রাহেলা খাতুন-৪৫ বছর, এরা লাওকরা গ্রামের, ১৩. সৈয়দ মোস্তফা কামাল-২৫ বছর, গ্রাম-লালবাগ, থানা-কোতয়ালী,জেলা-কুমিল্লা, ১৪. হুমায়ুন কবীর-১৮ বছর, ১৫. ফোরকান-১৫ বছর, গ্রাম-দেবকরা, থানা শাহরাস্তি।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত