লাকসামের প্রথম যুদ্ধ, কুমিল্লা
কুমিল্লা সদর থেকে উত্তরে এবং চাঁদপুরের পূর্বে ও চৌদ্দগ্রামের পাশ্চিমে লাকসাম থানা অবস্থিত। লাকসাম থানা কুমিল্লা জেলার অন্যান্য থানা থেকে বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে ভিন্নতর এবং গুরুত্বপূর্ণফেনী থেকে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত একটি শক্তিশালী রেল ব্যবস্থা এই থানার ওপর দিয়েই যাতায়াত করে থাকে।
স্থানীয়ভাবে ছাত্র, যুবক ও জনসাধারণের সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধারা সুবেদার লুতফর রহমানের তত্ত্বাবধানে ১০ এপ্রিল লাকসামে অবস্থানকারী এক প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। নোয়াখালী পরিষদ সদস্যদের দেওয়া কিছু টাকা ফরোয়ার্ড ডিফেন্স বাহিনীতে বন্টন করে দিতে সুবেদার লুতফর সকাল ১০ টায় লাকসামে যান। বেলা ১২ টার সময় তিনি খবর পান যে, পাকিস্তানীরা বাঘমারা থেকে লাকসামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সংকল্প করেন। লাকসামের সামান্য উত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে পজিশন নেওয়া হয়। মাত্র ৭০ জন স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সুবেদার লুতফর রহমান এই অভিযান পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দুইটি এল এম জি ছাড়া বাকি সবই ৩০৩ রাইফেল। সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর আগমনের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে বসে থাকেন। অ্যাম্বুশ পেতে বসে থাকার এক পর্যায়ে পাকিস্তানী হায়েনার দল যখন মুক্তিযোদ্ধাদের ফায়ারের আওতার মধ্যে চলে আসে তখনপি মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এ অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানী সেনাদলের দুইজন অফিসার ও প্রায় ২৬ জন সৈন্য নিহত হয়। এবং ৫০/৬০ জনের মত আহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিয়ে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উপর পালটা আক্রমণ ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রায় চারঘন্টা উভয়পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। এরই মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবর্ষণে শত্রুপক্ষের ২ টি ট্রাকে আগুন ধরে যায়। ক্রমেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে থাকা এ্যামুনিশন শেষ হতে থাকে। পিছন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অশ্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের সম্ভাবনা না থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগত কারণেই পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়। পক্ষান্তরে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর সাহায্যার্থে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহ দ্বিগুণ হওয়াতে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর তারা ব্যাপকভাবে গোলাগুলি করতে থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা অক্ষত অবস্থায় পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফলে পাকিস্তানী বাহিনী লাকসাম তাদের দখলে নিতে সক্ষম হয়। সুবেদার লুতফর রহমানের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেয় এবং রাতে স্থানীয় জনসাধারণের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। নাগবাবু, নুরুল হক ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের দুইজন সদস্য তাদের সংগ্রহকৃত ২ টা এল এম জি এবং ৪ টা এস এল আর এবং কিছু বিস্ফোরক দ্রব্য সুবেদার লুতফরের কাছে হস্তান্তর করে। উক্ত বিস্ফোরক দ্রব্য দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা দৌলতগঞ্জ সেতু ধ্বংস করে দিতে এবং লাকসাম নোয়াখালি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত