You dont have javascript enabled! Please enable it!

লালপুরের যুদ্ধ, নাটোর

১৯৭১ এর ২৯ মার্চ লালপুরে পাক হানাদার বাহিনী প্রথম অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। সেদিন স্থানীয় বীর বাঙালী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত এবং অবরোধের মুখে পড়তে হয় হানাদারদের। প্রথম রক্তপাত মূলত নাটোরে সেদিনই হয়। পাকিস্তানীরা হয় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। আর এজন্য দিনটি লালপুর বাসীর জন্য আরো স্মরনীয় হয়ে আছে। ময়নার খন্ডযুদ্ধে সেদিন পাকিস্তানীদের ২২ জিপ, ২২ পিক আপ, ৩৩ ট্রাকসহ শতাধিক সৈন্যের একটি পাকিস্তানী কনভয়ের সকল পাকসেনা হতাহত হয়। উক্ত যুদ্ধ চলে লাগাতার ১১ ঘন্টা এবং এতে প্রায় ১১ জন পাকসেনা নিহত হয়। প্রতিরোধ বাহিনীর লোক মারা যায় ৪১ জন এবং আহত হয় শতাধিক। রাতে পাকসেনারা দুটি ট্রাক ফেলে পালাতে সক্ষম হয়। কিন্তু পালানোর সময় ফেলে যায় মেজর রাজাসহ তিনজন সৈনিককে। পরের দিন ভিন্ন মাঠ ও গাঁয়ের পথে তাদের খোঁজ মেলে। তারা ছিল ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত এবং অবসন্ন। নারী বেশ ধরে খুঁজছিল আত্মরক্ষার পথ। কিন্তু পরে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপরে লালপুরের বিমলবাড়িয়ায় একটি পুরাতন পরিত্যক্ত স্থানে গণহত্যা চালানো হয়। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে গোটা জুন মাস এখানে তিনবার গণহত্যা চালানো হয়। কত লোক যে এই গণহত্যায় মারা যায় তার কোন সঠিক হিসেব কারো জানা নেই। কারণ তখন এলাকাটি ছিল সম্পূর্ণভাবে বিরানভূমি। গণহত্যার মূহুর্ত থেকেই এলাকার মানুষ নিভৃত পল্লীতে গিয়ে আত্মগোপন করেছিল। স্থানীয় গ্রামবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকারে জানা যায় যে স্থানীয় হাটের মসজিদসংলগ্ন মাঠে লাশের স্তুপ সেদিন পড়ে থাকে। ৮-১০ দিন ধরে লাশগুলো টানাটানি করে শেয়াল কুকুরে। গ্রামবাসীদের মধ্যে যারা সাহসী তারাই প্রথম গণহত্যার শেষ গোধূলি বেলায় নিজেদের ২১ টি লাশ সনাক্ত করে নিতে সমর্থ হয়। ২৬ মার্চ সকাল ১০ টার দিকে নওগাঁর ইপিআরের উয়িং কমান্ডার মেজর নাজমুল হক টেলিফোনে লালপুরের আনসার কমান্ডারকে জানান যে, নগরবাড়ি ঘাট থেকে একদল পাকিস্তানী সৈন্য রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসছে, যার ফল হবে মুক্তিবাহিনীর জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। যে কোন অবস্থায় তখন এদের প্রতিহত করা অপরিহার্য। সাথে সাথে আনসার কমান্ডার আফসার মিয়া আতাহার আলী, জাহিদুল হাকিম, আব্দুর রশীদের সঙ্গে এই ব্যাপারে আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেয় যে, যে কোন মূল্যেই তাদের মোকাবেলা করতে হবে, হয় বাঁচা নয় মরা। বিষয়টি মেজর নাজমুল হককে অবহিত করে ঐ দিনই সন্ধ্যার সময় পাবনা অভিমুখে রওয়ানা হল আনসাররা। পাবনা থেকে যে রাস্তাটি রাজশাহীর দিকে গিয়েছেতার কাছেই মোলাডুলি। ঐখানেই বৃষ্টির মত গোলাগুলি ছুড়তে থাকে আনসাররা, যা পাকিস্তানীরা মোটেই আশা করেনি। তাই আনসারদের গুলির সামনে টিকতে না পেরে তারা পিছিয়ে গিয়ে অন্যপথে রাজশাহীর দিকে এগুতে থাকে। এইসময় আনসার কমান্ডার মো. ইউসুফ এই মর্মে মতামত দেন যে, পাকবাহিনী নিশ্চয় গোপালপুর-বনপাড়া রাস্তা ধরে অগ্রসর হচ্ছে। সকলেই ইউসুফের কথায় একমত পোষণ করে দ্রুত বনপাড়ার দিকে এগিয়ে যায়। রাত ১০ টায় আনসার বাহিনী বনপাড়ায় পৌঁছে যায় এবং সাথে সাথে খবর পাওয়া যায় যে, পাকবাহিনী গোপালপুর হয়ে রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসছে। আর তাই কালবিলম্ব না করে আনসারদের গোপালপুরের দিকে অগ্রসর হতে আদেশ দেওয়া হয়। ৫-৬ মেইল যাওয়ার পর ওয়ালিয়ায় ২য় বারের মত আনসাররা পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয়। প্রকৃতপক্ষে সমস্ত রাত এবং পরের দিন পর্যন্ত তাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ চলে। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ পাকবাহিনী কভারিং ফায়ারের মাধ্যমে পিছু হটতে শুরু করে। ঐসময় কমান্ডার ইউসুফ, মেহের আলী, মোজাম্মেল সাত্তার (প্রাক্তন সৈনিক) এদের পরামর্শ অনুযায়ী ইউসুফের কমান্ডে ২২ আনসার প্লাটুন (৬০ জন) ভিন্ন পথ ধরে দ্রুত গতিতে রওয়ানা করে যাতে করে পাকবাহিনীর আগেই গোপালপুর রেল স্টেশনে পৌঁছানো যায়। পাক বাহিনী পৌঁছানোর আগেই তারা গোপালপুর রেল স্টেশনে পজিশন নেয়। স্থানীয় জনসাধারণের সাহায্যে রেলের ওয়াগন দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। এই ব্যারিকেডের খবর এবং আনসারদের অবস্থান পাকবাহিনী আন্দাজও করতে পারেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকবাহিনী গোপালপুর স্টেশনের কাছে পৌঁছে ব্যারিকেড দেখতে পেয়ে জোয়ানদের নামিয়ে দেয় উক্ত ব্যারিকেড সরানোর জন্য। এই সুযোগেই আনসার বাহিনী অকস্মাৎ তাদের উপর গুলি চালাতে শুরু করে। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে স্থানীয় জনসাধারণ তুমুল উদ্দীপনায় যার যা আছে তাই নিয়ে আনসারদের সঙ্গে যোগ দেয়। ঘন্টাখানেক যুদ্ধের পর ২২ জন পাক বাহিনীর সৈন্য সেদিন নিহত হয়।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!