You dont have javascript enabled! Please enable it!

রৌমারী যুদ্ধ, রংপুর

১৬ সেপ্টেম্বর ‘সি’ কোম্পানী এবং ‘এ’ কোম্পানীর একটি প্লাটুন লেঃ কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে রৌমারীর চর কোদালকাটিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়। ২১ সেপ্টেম্বর শত্রুর দুই কোম্পানী সৈন্য মর্টারের সাহায্যে চরকোদাল আক্রমণ করে। মুক্তিসেনারা অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্রায় ৩৫ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিসেনাদের ৫ জন আহত হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর সকালবেলা শত্রুপক্ষ পুনরায় ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে কোদালকাটি আক্রমণ করে। এবার তুমুল যুদ্ধ হয়। এবং মুক্তিসেনারা এবারও তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। মুক্তিসেনারা ১৫ জন আহত হয়। কোদালকাটির এ যুদ্ধের নায়েক সুবেদার আবুল হাশেম, হাবিলদার মকবুল হোসেন, ল্যান্সনায়েক আতাউর রহমান, ল্যান্সনায়েক আব্দুল হক প্রমুখ সৈন্যগন অপূর্ব বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এ যুদ্ধে যে সমস্ত সৈন্যগণ সাহসিকতার পদকপ্রাপ্ত, তাঁরা হচ্ছেন ল্যান্সনায়েক আব্দুল হক (বীর বিক্রম) এবং (২) হাবিলদার মকবুল হোসেন (বীর প্রতীক)। কোদালকাটির যুদ্ধে পাকিস্তানী ৭০ জন সৈন্য নিহত হওয়ায় এবং মুক্তিবাহিনীর নিকট পরাজিত হওয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যদের মনোবল অত্যন্ত ভেঙে পড়ে। ফলে কোদালকাটি ও রৌমারী এলাকা সর্বময় মুক্ত থাকে এবং সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে।
সিলেটের চা বাগানসমূহ ও অন্যান্য এলাকায় যুদ্ধ অক্টোবর মাসের ১ম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ব্যাটালিয়নকে সিলেট সীমান্তে যাবার জন্য আদেশ করা হয়। হাফিজ উদ্দীন ও তার ব্যাটালিয়ন উক্ত আদেশ পাবার পর কোদালকাটি ও রৌমারি ত্যাগ করে সিলেট সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় চলে যান। সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে থাকত। পাকিস্তান সরকারেরে উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য ক্যাপ্টেন হাফিজ ও তার ব্যাটালিয়ানকে সিলেটের চা ফ্যাক্টরি গুলো সাময়িক ভাবে নষ্ট করার আদেশ দেওয়া হয়। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে হাফিজের নেতৃত্বে ‘এ’ কোম্পানী ও ‘সি’ কোম্পানী শত্রুর ঘাঁটির মাঝখান দিয়ে প্রবেশ করে এবং ফ্যাক্টরীগুলোকে সাময়িকভাবে অচল করে দেয়।
১৯ অক্টোবর হাফিজ ‘বি’ কোম্পানী নিয়ে পুনরায় চা ফ্যাক্টরির উপরে ‘রেইড’ করেন এবং সেটা নষ্ট করে দেন। এ রকম রেইডের ফলে পাকিস্তানি সৈন্যদের মনোবল কিছুটা ভেঙে পড়ে এবং বাঙালি জনসাধারণের মনে অনেক আশা উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। এ সমস্ত রেইডের সময় ডা. মজিবর রহমান অত্যন্ত সাহসের সাথে আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করেন এবং ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে কোম্পানীর সাথে থাকেন। এসময় সেকেন্ড লেঃ আনিসুর রহমান ও সেকেন্ড লেঃ ওয়াকার হাসান নতুন কমিশন প্রাপ্তির পর ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বাধীন ব্যাটালিয়ানে যোগদান করেন।
২৮ অক্টোবর সকালে ক্যাপ্টেন হাফিজ ‘বি’ কোম্পানীকে নিয়ে পাত্রখোলা চা ফ্যাক্টরীর আর্টিলারী সাহায্য নিয়ে পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ করেন এবং ঘাঁটিটি দখল করতে সক্ষম হন। একইদিন লেঃ কাইইয়ুমের নেতৃতে ‘সি’ কোম্পানী ধালাই শত্রুঘটির উপর রেইড করে শত্রুপক্ষের বহু সৈনিককে হতাহত করে। সিপাই হামিদুর রহমান এ রেইডে অভূতপূর্ব সাহসের পরিচয় দেন এবং নিজে গুরুতরভাবে আহত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর এলএমজির সাহায্যে একাই প্রায় ২০ জন সৈন্য নিহত করেন। এ যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সাথে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে শহীদ হন। বাংলাদেশ সরকার তাঁর এ অসীম সাহসিকতার সর্বোচ্চ পুরষ্কার ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব পুরষ্কার দিয়ে শহীদ আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। তাঁর বান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
ধালাই থেকে শত্রুসেনারা পাত্রখোলার দিকে অগ্রসর হতে থাকে ক্যাপ্টেন মাহবুব মাত্র ৪ জন সৈন্য সাথে নিয়ে ধালাই ও পাত্রখোলার বড় সড়কের মাঝামাঝি স্থানে অ্যাম্বুশ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ফাঁদে পা দিলে তিনি শত্রুপক্ষের প্রায় ২০ জন সৈন্যকে নিহত করেন এবং দুজনকে জীবিত অবস্থায় বন্দী করেন। ঐ দিনই ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে ডী কোম্পানী পাত্র খোলার ফ্যাক্টরীর দুই মাইল দক্ষিণে কাট অফ পার্টি হিসেবে অবস্থান নেয়। শত্রুরা দুই কোম্পানী পাত্রখোলার দিকে অগ্রসর হতে থাকলে ‘ডি’ কোম্পানী তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেয়। শত্রুপক্ষের একজন ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ৩০ জন নিহত হয়। মুক্তিসেনাদের পক্ষে ৬ জন সেনা শহীদ নিহত হন।
১ নভেম্বর এই দিনে মিত্রবাহিনীর দুই ব্যাটালিয়নসহ ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ধালাও বিওপি এবং ফ্যাক্টরী এলাকায় যা শত্রুর সুদৃঢ় ঘাঁটি ছিল তার উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালান। দুদিন ধরে অনবরত প্রচন্ড যুদ্ধের পর শত্রু ঘাঁটি দখল করেন। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩০ তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য (প্রায় ২০০) নিহত হয় এবং বহু আহত হয়।
নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিলেটের চারগ্রাম ও আটগ্রাম এলাকায় শত্রুঘাঁটির উপরে কড়া রকমের একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেজন্য সব কমান্ডিং অফিসার এবং কোম্পানি কমান্ডারগণ এ এলাকা ভালোভাবে রেকি করেন। ২২ নভেম্বর সকালে ক্যাপ্টেন হাফিজ ‘বি কোম্পানী নিয়ে আর্টিলারীর সাহায্যে চারগ্রামে শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করেন। এ ঘাঁটি থেকে ক্যাপ্টেন হাফিজ প্রচুর পরিমান অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দখল করেন। এ যুদ্ধে সাফল্য লাভ করাতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। এ যুদ্ধে ‘বি’ কোম্পানী অত্যন্ত সাহস ও রণকৌশল প্রদর্শন করেন। একই দিনে ‘সি’ কোম্পানীর ক্যাপ্টেন নূরের নেতৃত্বে আটগ্রাম ব্রিজ এলাকা আক্রমণ করে এবং দখল করে নেয়। এ স্থানেও মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর পরিমানে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করতে সক্ষম হন। এভাবে মুক্তিযোদ্ধারা চারগ্রাম এবং আটগ্রাম এলাকাকে সম্পূর্নরূপে শত্রুমুক্ত করে। এ যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় স্বরূপ নিম্নলিখিত সৈন্যগণকে সাহসিকতার পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তাঁরা হলেন নায়েক সুবেদার আবুল কাশেম (বীরবিক্রম)। নায়েক সুবেদার মোহাম্মাদ ইব্রাহিম (বীরবিক্রম)। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে সিলেটের দিকে পশ্চাদপসরণ করে।মুক্তিযোদ্ধারা মেজর জিয়াউদ্দিনের সুযোগ্য নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যদের অনুসরণ করতে থাকে। শত্রুরা পলায়নের সময় বেশ কয়েকটি পুল উড়িয়ে দেয় এবং রাস্তাঘাটে প্রচুর মাইন পুঁতে রাখে। মাইন পোতা রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে তাদের পিছনে যেতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা। এবং গৌরীপুর এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয় তারা।
২৮ নভেম্বর একদিন ভোরে পাকিস্তানি ৩১ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট মুক্তিযোদ্ধাদের ‘এ’ কোম্পানীর পজিশনের উপর আক্রমণ করে। ‘এ’ কোম্পানী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্রায় ১০০ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ১০/১১ জন শহীদ এবং প্রায় ২০ জন যোদ্ধা আহত হয়। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্র শত্রুপক্ষের মরা লাশে ভরে যায়। ‘এ’ কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুব বীরত্বের সাথে যুদ্ধকালীন সময়ে শহীদ হবার পর ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। যুদ্ধকালীন সময়ে ক্যাপ্টেন মাহবুব শহীদ হবার পর তদস্থলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী যুদ্ধকালীন সময়ে ‘এ’ কোম্পানীর কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সাবেক পাকিস্তান এয়ারফোর্সের একজন পাইলট ছিলেন্তবে এ ধরণের পদাতিক যুদ্ধে তাঁর কোন অভিজ্ঞতা ছিলনা। একটুপরে তিনি শত্রুর বুলেটে মারাত্মকভাবে আহত হন। কিন্তু তবুও তিনি আহত অবস্থায় বীরত্বের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং শত্রুর দৃঢ় আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেন। এ যুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য তাঁকে ‘বীর উত্তম’ এবং লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসানকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিসেনারা ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২৫ জন সৈন্যকে জীবিত অবস্থায় বন্দি করে। যুদ্ধবন্দিদের জবানবন্দিতে জানা যায় যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যে এত সাহসের সাথে, এত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে পারে তা আমাদের আগে জানা ছিলনা। যুদ্ধে পরাজিত হবার পর তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং সিলেটের দিকে পালিয়ে যায়। এ সময় মিত্র বাহিনীও পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে এবং আক্রমণ করে। ৪/৫ গুর্খা রেজিমেন্টকে এবং আর্টিলারী গানসহ সিলেট শহর থেকে প্রায় ৮ মাইল দূরে হেলিকপ্টার যোগে নামিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান স্থির করেন সিলেট শহরে অন্যান্য সকল বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করবে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন যে, পাকবাহিনীর শত্রু ঘাঁটিগুলো ভেদ করে অনুপ্রবেশ করবেন। মিত্রবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের হেলিকপ্টার যোগে খাদ্য, রসদ ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের প্রতিশ্রুতিও দিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা জলাভূমি, খাল, বিল ইত্যাদি আক্রমণ করে প্রবেশ শুরু করে। এসময় অত্যন্ত শীত ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট শীতবস্ত্র মোটেই ছিলনা। তবুও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারছিলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয় অতি নিকটে। পরপর তিন রাত খাল বিল এবং জলাভূমির মধ্যে দিয়ে চলাচল করে শত্রুঘাঁটির নিকট ও চা বাগানে প্রবেশ করেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কোন খাদ্যদ্রব্য ছিলনা এবং একটানা হাঁটার ফলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবুও বিপুল উৎসাহে এবং আগ্রহ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা চা বাগানের ভিতর দিয়ে সিলেট শহরের দিকে এগিয়ে যায়। চিকনাগুল চা বাগানে একটি মোজাহিদ কোম্পানীকে লেফটেন্যান্ট মুদাসসিরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রেখে যান হেলকপ্টারযোগে মিত্রবাহিনীর কাছ থেকে খাদ্যদ্রব্য ও রসদ সংগ্রহের জন্য। ওয়ারলেসের সাহায্যে মেসেজ দেওয়া সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী কোন সাহায্য পেলনা। শত্রুপক্ষ কালাগুল চা বাগানের মুক্তিবাহিনীকে বাধা প্রদান করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অল্প কয়েকজন যোদ্ধা হতাহত হন। তখন মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুঘাঁটি এড়িয়ে যান। এবং ১৪ ডিসেম্বর ভোরে সিলেট শহরে ঢুকে এম সি কলেজ এলাকায় প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধারা। এম সি কলেজ শত্রুর অত্যন্ত শক্ত ঘাঁটি ছিল। মুক্তিবাহিনী শত্রুপক্ষ থেকে ৫০০ গজ দূরে এম সি কলেজের উত্তর দিকে টিলাগুলির উপর ডিফেন্স নেন। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সামনে ‘বি’ কোম্পানী ‘এ’ ডি কোম্পানী যথাক্রমে ছিল ক্যাপ্টেন হাফিজ ও ক্যাপ্টেন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে। পিছনে ‘এ’ কোম্পানী ও ‘সি’ কোম্পানী লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে ছিল। ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টারসহ মেজর জিয়াউর রহমান এই চার কোম্পানীর মাঝামাঝি একটি টিলায় অবস্থান করছিলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারীর একজন ব্যাটারী কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু অয়ারলেসের মাধ্যমে তিনি তার গান পজিশনের সাথে যোগাযোগ রাখতে ব্যর্থ হন। প্রায় তিনদিন ‘বি’ কোম্পানীর সৈন্যরা অনাহারে ছিলেন। তবুও শত্রুর নাকের ডগায় ট্রেঞ্চ খুঁড়ে পজিশন নিতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা। শত্রুপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের অতি নিকটে ছিল এবং নির্বিকার ভাবে মুক্তিবাহিনীর কার্যকলাপ লক্ষ করছিল। তারা চিন্তাও করতে পারেনি যে, এরা হল মুক্তিবাহিনীর দল। কারণ মুক্তিবাহিনীর পোশাক, স্টিল হেলমেট, অস্ত্রশস্ত্র তাদের মতোই ছিল। তাছাড়া এ সময় যুদ্ধ চলছিল ‘বি’ কোম্পানীর পিছনে এবং বাঁদিকে প্রায় ৫ মেইল দূরে খাদিমনগর। মুক্তিবাহিনী শত্রুর পজিশনের ভিতর দিয়ে এত তাড়াতাড়ি সিলেট শহরে প্রবেশ করবে, তারা তা ভাবতেও পারেনি। একটু পরে চিৎকার করে তারা ‘বি’ কোম্পানীর পরিচয় জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চিৎকারের জবাব না দিয়ে চুপচাপ ট্রেঞ্চ খুঁড়তে থাকে। এসময় ‘ডি’ কোম্পানীর পজিশনের সামনে রাস্তায় একটি আর্টিলারী গান ওও দুটি জীপের কনভয় থামে। তখন ‘ডি’ কোম্পানীর কমান্ডার মর্টারের সাহায্যে উক্ত কনভয়ের উপর গোলা বর্ষণ করেন। যার ফলে একটি জিপে আগুণ ধরে যায়। শত্রু তখন মুক্তিযোদ্ধাদের উপর সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে এদিক সেদিক চলাফেরা করতে থাকে। এ সুযোগে মুক্তিবাহিনী মেশিনগান এবং হালকা মেশিনগান দিয়ে তাদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। ফলে পাকবাহিনীর ২৫ জন সৈন্য রাস্তার উপর হতাহত হয়। শত্রুপক্ষ তখন মর্টারের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। এবং তাদের সৈন্যদের মৃতদেহ সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর নিখুঁত গুলিবর্ষণের ফলে শত্রুপক্ষের আরো বেশকিছু সৈন্য হতাহত হয়। দুপুরের সময় শত্রুরা বাধ্য হয়ে তাদের সর্বশক্তি দিয়ে এবং মর্টারের প্রবল গোলাবর্ষণের সাহায্যে ক্যাপ্টেন হাফিজের ‘বি’ কম্পানীর উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর মর্টারের গোলা শেষ হয়ে যায়। তবুও মুক্তিযোদ্ধারা হালকা মেশিনগান এবং রাইফেলের সাহায্যে দৃঢ়তার সাথে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে। এ আক্রমনের ফলে শত্রুবাহিনীর প্রায় ৮০ জন সৈন্য নিহত হয় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর ‘বি’ এবং ‘ডি’ কোম্পানীর প্রায় ২০ জন সৈন্য শহীদ হন এবং ক্যাপ্টেন হাফিজের সবচেয়ে সুযোগ্য সুবেদার ফয়েজ আহমেদ অসীম সাহস এবং রণকৌশল প্রদর্শণ করে শহীদ হন। তাঁকে ‘বীর উত্তম’ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এ যুদ্ধে সিপাই বাচ্চু মিয়া, নায়েক নুরুন্নবী, সিপাই ফজর আলী, সিপাই মহিউদ্দীন ও নায়েক আফসার আলী অসাধারণ সাহসের পরিচয় দিয়ে শহীদ হন।
এ যুদ্ধে নিম্নলিখিত যোদ্ধাগণ অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন এবং বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁদেরকে খেতাবে ভূষিত করেন। তারা হলেন ক্যাপ্টেন বজলুল গণি পাটওয়ারী (বীর প্রতীক), নায়েক সুবেদার হোসেন আলী তালুকদার (বীর প্রতীক), হাবিলদার নুরুল হক (বীর বিক্রম), শহীদ সুবেদার ফয়েজ আহমেদ (বীর উত্তম), হাবিলদার সাইফুদ্দিন (বীর প্রতীক), সুবেদার খাইরুল বাশার (বীর প্রতীক), নায়েক সুবেদার আবদুল লতিফ (বীর প্রতীক), ল্যান্স নায়েক আবুল বাশার (বীর প্রতীক) ও হাবিলদার আব্দুল লতিফ (বীর প্রতীক)।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!