রায়পুর মেথিকান্দা রেল স্টেশনে হানা, নরসিংদী
এপ্রিল ৭১ এ ঢাকা-নরসিংদী সড়ক পাক সেনামুক্ত রাখার জন্য যখন ৩ নং সেক্টরের ২ ইস্ট বেঙ্গল, ইপিআর ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রয়াস চালাচ্ছিল তখন পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ নরসিংদী এলাকায় সেনা প্রেরণ করে। পাকসেনাদের আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা (ক্যাপ্টেন মতিউর এর নেতৃত্ব এক কোম্পানি ইপিআর সদস্য ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা) যদিও পিছু হটে যায় তবুও বিচ্ছিন্নভাবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী তথা সরকারকে কাবু এবং নিজেদেরকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন রেইড, অ্যামবুশ ও নাশকতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। এরই অংশ হিসেবা রায়পুর মেথিকান্দা রেলস্টেশনে হানা দ্যে কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে। মেথিকান্দা রেলওয়ে স্টেশন গ্রীডসূত্র ৯৭০৫৭৫, বাংলাদেশ ম্যাপ সীট নং ৭৯ আই/১৮ রায়পুরা মেথিকান্দা রেলওয়ে স্টেশনটি রায়পুরা থানা সদর থেকে ৫০০ মিটার পশ্চিমে ধাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের উপর অবস্থিত। রায়পুরা থানা সদরটি নরসিংদী থেকে রেলপথ বরাবর ১৫ কি.মি পূর্বে এবং বর্তমানে ঢাকা- সিলেট মহাসড়কের বারিচা নামক স্থানের ৫ কি.মি দক্ষিণে অবস্থিত। এই হানাটি ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল সংঘটিত হয়। মুক্তিযোদ্ধা দারুল ইসলাম এপ্রিল মাসের দিকে ৫/৬ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে রায়পুরা থানা সদরের আশেপাশে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। উক্ত দলের অধিকাংশ সদস্য প্রাক্তন ২ ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিক ছিলেন। উক্ত সময়ে ১৪ এপ্রিল জনৈক রিক্সাওয়ালা জুমা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার দারুল ইসলামের নিকট এই মর্মে সংবাদ দেন যে, রায়পুরা পুলিশ থানা সদর থেকে সমস্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ এস আই মান্নানের নেতৃত্বে ১৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ মহকুমা সদরের উদ্দেশ্যে গমন করার জন্য সকালে মেথিকান্দা রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠবে। উক্ত সংবাদ প্রাপ্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেন যে, মেথিকান্দা রেলওয়ে স্টেশনে যখন অস্ত্রগুলো নেয়ার জন্য জমা করা হবে তখন অতর্কিতে তাদের উপর হামলা চালিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিনিয়ে নেয়া হবে। মুক্তিযোদ্ধা দারুল ইসলাম তার নেতৃত্ব আরো ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ১০ জন বেসামরিক জনগণ নিয়ে হানা দল গঠন করেন। গতি, গোপনীয়তা ও ক্ষিপ্রতাই এই অপারেশনের মূল উপাদান বলে বিবেচিত হয়। ১৫ এপ্রিল সকাল দশটায় পুলিশ ও ৭/৮ জন শত্রুসেনা (অনুমান অনুযায়ী তদানিন্তন ইপিআর অথবা পুলিশের সদস্য) মেথিকান্দা স্টেশনে জমায়েত হয় ও ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। শত্রুর উপর আক্রমণের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল। পাকবাহিনীর অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে রেললাইনের পশ্চিম দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে তাদের উপর হামলা করে। এই আক্রমণে অত্যন্ত কম সময়ের জন্য গুলি বিনিময় হয় (মতান্তরে কোনো গোলাগুলিরই প্রয়োজন হয়নি বা ফাঁকা গুলি করা হয়) স্বল্প সময়ের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সেখান থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে পালিয়ে যায়। কেননা অদূরেই পাকসেনারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, ক্ষিপ্রতা ও উদ্দামের ফলে তারা এ অপারেশনের সাফল্য লাভ করেন। ফলাফলঃ এ অপারেশনে ২৪ থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ১টি রিভলবার ও ১ বাক্স গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। এই অপারেশনে মেথিকান্দা রেলওয়ে স্টেশনে একজন ৭/৮ বছরের ছেলে মারা যায়। এ অপারেশনটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকের অপারেশন। কাজেই এর সাফল্যের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায় এবং উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ পরবরতীকালে আরো মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনে ও অভিযান পরিচালনার কাজে ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য এ অস্ত্র ও গোলাবারুদগুলো ২ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গফুরের নিকট দেয়া হয় যা তিনি পরবর্তীতে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বন্টন করেন।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত