রাধারনগর যুদ্ধ, সিলেট
[অংশগ্রহণকারীর বিবরণ]
৫নং সেক্টরের অধীনে যতগুলি যুদ্ধ হয়েছিল তার মধ্যে রাধারনগর যুদ্ধ ছিল অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও বিবিসি থেকে প্রায়ই শওকত আলী , ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশন জোনের জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) মেজর জেনারেল গুলবক্স সিং গিল ছিলেন এই সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর অপারেশনের প্রধান সমন্বয়কারী। মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগরের প্রতিরক্ষার ওপর কয়েকবার উপর্যুপরি আক্রমণ করে কিন্তু কোনোবারই যথেষ্ট সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এটা ১৯৭১ সনের নভেম্বর মাসের ২৪ বা ২৫ তারিখ। রাধানগর ও ছোটখেলে পাকিস্তানী আর্মির ৩১ পাঞ্জাবের ১ কোম্পানির অধিক পাক সেনা প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল, সঙ্গে ইসকাপ, রাজাকার প্রভৃতি। উত্তরে সিলেট সীমান্তের রাধানগর ছিল পাক বাহিনীর প্রধান প্রতিরক্ষা অবস্থান এবং ছোটখেলের পেছনে (দক্ষিণে) গোয়াইনঘাটে পাক বাহিনীর আর একটি শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। ছোটখেল থেকে সিলেটের সালুটিকার বিমান ঘাঁটি এই এক্সিজ (জাফলং-রাধানগর-গোয়াইনঘাট-সালুটিকর) সিলেট শহরে পৌঁছার সংক্ষিপ্ততম দূরত্ব।
আমার কোম্পানি সব সময় মুক্তাপুর এলাকায় বাংলাদেশের সীমান্তে অবস্থান করত। ৫/৫ গুর্খা রাইফেলস আমাদের সাব-সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর সকল অপারেশনের প্রধান সমন্বয়কারী ছিল। লে. কর্নেল ভি.এন.রাও ছিলেন এই রেজিমেন্টের অধিনায়ক। ২১ নভেম্বর থেক যৌঠ কমান্ড স্থাপন হওয়ার পর ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি আক্রমণ এই রেজিমেন্টের সকল পদবির সৈনিকদের সঙ্গে সিলেটের চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত আমি এবং আমার কোম্পানি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। সম্ভবত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কোনো ভারতীয় পদাতিক ব্যাটালিয়নের অংশগ্রহন এটাই প্রথম ব্যাটালিয়ন।
এই আক্রমণের পূর্বে ২২ ও ২৩ নভেম্বরের দিগারইল যুদ্ধের ধকল শেষ না করতেই যদিও প্রায় প্রতিটি সৈনিক ক্লান্ত ছিল, তবুও কর্তব্যপরায়ণতা ও দেশপ্রেম আমাদেরকে প্রচণ্ড সম্মুখ যুদ্ধে নিয়ে যেতে মোটেই অসুবিধা করেনি। ভোর হবার কিছু আগে প্রায় ৪টা ৫০ মিনিটে এফইউপি (FUP-Forming Up Place, যেখান থেকে সরাসরি হামলা শুরু হয়) থেকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয় সবাই। ৩য় ইস্ট বেঙ্গল এর ২ কোম্পানি যথা আলফা ও ডেল্টা কোম্পানি ফায়ার সাপোর্ট দেবার কথা। ডাউকি সীমান্ত থেকে ভারতীয় আর্টিলারি ও মর্টার অবিরাম ফায়ার করে আক্রমণের পথ সহকরে দেবে। মেজর সাম্ভায়া একটি গুর্খা কোম্পানির ও মেজর এস.পি. সিং অন্য একটি কোম্পানির আক্রমণে ছিলেন রাইইফেল উঁচিয়ে রণধনি ও গুর্খাদের আয়ো-গুর্খালি যার অর্থ গুর্খা এসে গেছে, জয় বাংলা, ইয়া হায়দর ধ্বনিতে ফায়ার করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শীতের রাত ঘন কুয়াশা-একই সংগে রাধানগর ও ছোটখেল দু’জায়গায় আক্রমণ এবং পেছন থেকে কাভারিং ফায়ারের উপর এসে পড়ায় পাক আর্মির মেশিগানের লাইন অব ফায়ারে পড়ে যায়। গুর্খা কোম্পানি অফিসার লে. দেবপাল ও মেজর এস.পি.সিং তৎক্ষণাৎ শত্রু গোলায় নিহত হন। এছাড়া কোম্পানির কয়েকজন ও গুর্খাদের প্রায় ৪০ জকন এই আক্রমণের সময় আহত হয়। প্রায় ৩০০ গজ দূর থেকেও শত্রুদের উৎখাত করা যায় নাই, তবে ছোটখেল দখলে চলে আসে। একদিকে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করা আর অন্যদিকে মৃত্যুর করাল্গ্রাস জীবন।
সদিন রাতেই ডাউকি বিএসএফ হেডকোয়ার্টারে জেনারেল গিল-এর অপারেশনাল ব্রিফিং হলো। জেনারেল গিল ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট অধিনায়ক লে. কর্নেল ভি.এন. রাওকে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতির জন্য সহনুভূতি জানালেন। ভোর রাতে ২টি কোম্পানি সৈন্য ও মুক্তি বাহিনীর ৩টি কোম্পানি নিয়ে আক্রমণের নির্দেশ এল। একটি আর্তিলারি রেজিমেন্টের প্রবল (আন্ডা) বর্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আর্টিলারি বা মর্টারের গোলাকে কোড-ওয়ার্ড হিসাবে আন্ডা বা ডিম বলা হতো/ মাতৃভূমির মুক্তির জন্য সবাই প্রস্তুত (FUP) তে পৌছার আগেই সবাই প্রস্তুত। প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু হলো/ সকালে নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে শত্রুর অবস্থানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো/ প্রায় ৩০ মিনিটের মধ্যে সকল প্রতিরোধ ভেদ করে শত্রুর সকল বাঙ্কার মুক্তিসেনারা দখল করে নেয়। চারদিকে পলায়নরত পাকিস্তানী সেনাদের মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। পাক সেনাদের প্রচুর অস্ত্র-গোলাবারুদ আর খাদ্যসামগ্রী হস্তগত হয়। কয়েকজন সৈন্যও বন্দি হয়, বাকিরা হয় নিহত বা পালিয়ে যায়। অপরদিকে দুঃখের জগগদ্দল পাথর চেপে বস্ল কতিপয় সহযোদ্ধা হত ও আহত হবার দুঃসহ বেদনায়। রাধানগর দখলের এই অবিস্মরণীয় ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবজনক অধ্যায়। পাশের ছোটখেলেও ইতিমধ্যে কর্নেল সাফায়াত জামিলের হাতে পাকিস্তানীদের পতন হয় যদিও তিনি ভোরে গুলিতে আহত হন এবং তাঁকে শিলং মিলিটারি হাসপাতালে ডাউকি থেকে হেলিকপ্টারে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করা হয়।
[৪১] জয়ন্ত কুমার সেন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত