You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাধানগরের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী, সিলেট

সিলেট সেক্টরে রাধানগরে যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী সরাসরি অংশগ্রহনের পরিকল্পনা করে। ৩ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল ও গণবাহিনীর কোম্পানিগুলো নিয়ে প্রথম তিন দিক দিয়ে রাধানগরকে অবরোধ করার পরিকল্পনা গ্রহন করে। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যে, অবরোধ কার্যকারী হওয়ার পর প্রথমে মিত্রবাহিনী ছোটখেল আক্রমণ করবে। ভারতীয়দের আক্রমণে মুক্তিবাহিনী সহায়তা করবে। পরবর্তীতে ভারতীয় বাহিনী ছোটখেল আক্রমণ করবে। ভারতীয়দের আক্রমণে মুক্তিবাহিনী সহায়তা করবে। পরবর্তীতে ভারতীয় বাহিনী ছোটখেল দখলে রাখতে ব্যর্থ হলে মুক্তিবাহিনীর ৩ ইস্ট বেঙ্গল ছোটখেল দখল করে। ৩ ইস্ট বেঙ্গলের লেফটেন্যান্ট এস আই এম নুরুন্নবী খান পরিকল্পনা ও সমন্বয়ে বিশেষ ভুমিকা রাখেন। যুদ্ধের বিবরণঃ
ক. লুনি গ্রামে ৬ নভেম্বর রাধানগর কমপ্লেক্সর এক পর্যায়ের যুদ্ধ শুরু হয়। লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী ডেল্টা কোম্পানি নিয়ে জাফ্লং চা বাগান সংলগ্ন লুনি গ্রামের অবস্থানে গিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহন করে। লেফটেন্যান্ট মঞ্জুরের আলফা কোম্পানি রাধানগর দুলের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে কাফাউড়া গ্রামে প্রতিরক্ষা গ্রহণ করে। প্রতাপ্পুরে ৩ ইস্ট বেঙ্গলের ব্যাটালিয়ন সদর স্থাপন করা হয়।
খ. ৭ নভেম্বর মধ্যে ৩ ইস্ট বেঙ্গলের কোম্পানিগুলো প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহন করে। ইতোমদ্ধে সুবেদার মোশাররফ তার গণবাহিনী কোম্পানি নিয়ে লুনি গ্রামের দক্ষিণ ও পশ্চিম প্রান্তে এবং লেফটেন্যান্ট মতিউরের গণবাহিনী কোম্পানি রাধানগরের উত্তরে অবস্থান গ্রহন করে। রাধানগরের উত্তর-পূর্ব দিকে কাফাউড়া গ্রামকে পশ্চিমে রেখে মুজাহিদ ক্যাপ্টেন দাউদের কোম্পানি অবস্থান নিয়েছিল। এছাড়া হাবিলদার (ইপিআর) রফিকের একটি গণবাহিনী কোম্পানি ও লুনি গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামটিতে বহুদিন থেকেই অবস্থান নিয়েছিল।
গ. ৭ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী একটি পাকিস্তানী বাহিনীর টহলের ওপর গুলি করলে লুনি গ্রামে উভয় পক্ষের প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। ৮ নভেম্বর শত্রুরদের একটি দল গ্রামের মুক্তিবাহিনী অবস্থানে দুটি আক্রমণ পরিচালনা করে।
ঘ. রাধানগর অবরোধ অপারেশনের জন্য লেফটেন্যান্ট নবীর কোম্পানি ঘোরা ও সত্তারগাও গ্রামে প্রতিরক্ষা গ্রহন করে। এভাবে ১৩ নভেম্বর সন্দাহ পর্যন্ত রাধানগর কমপ্লক্সের পাক অবস্থান ঘিরে উত্তর-পূর্বে লেফটেন্যান্ট মঞ্জুর (আলফা কোম্পানি) ও মুজাহিদ ক্যাপ্টেন দাউদের গণবাহিনী কোম্পানি, উত্তরে লেফটেন্যান্ট মতিউরের গণবাহিনী কোম্পানি, উত্তরে লেফটেন্যান্ট মতিউরের গণবাহিনী কোম্পানি, পশ্চিমে সুবেদার মোশাররফ ও হাবিলদার রফিকের গণবাহিনী কোম্পানি, দক্ষিণ –পশ্চিমে ডেল্টা ও ইকো কমাপ্নি অবস্থান নিয়েছিল। একমাত্র রাধানগর-গোয়াইনঘাট সড়কটি শত্রুদের নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য খোলা ছিল।
ঙ. ১৪ নভেম্বর তারিখে, ৩ ইস্ট বেঙ্গলের দুটি প্লাটুন ও ছাত্র কোম্পানির একটি প্লাটুন ছাতক থেকে এসে লেফটেন্যান্ট নবীর সাথে যোগ দেয়। রাধানগর অবরোধ অপারেশনের গুরুত্ব বিবেচনা করে মেজর শাফায়াত তাদেরকে ছাতক এলাকা থেকে প্রত্যাহার করে রাধারনগর এলাকায় আনেন। প্লাটুনগুলো সাত্তারগাঁও ও দুয়ারীখেল গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর দুয়ারীখেল, সওারগাঁ এবং ঘেরা গ্রামের অবস্থানগুলো শত্রুদের ভয়ের কারণ ছিল। ওরা বুঝতে পেরেছিল মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে রাধানগর ও ছোটখেল অবস্থান ঘিরে ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে শত্রুরা তিনটি অবস্থান হতে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে মুক্তিবাহিনীকে সরিয়ে ফেলার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে লেফটেন্যান্ট খালেদকে খাইরাই-গোয়াইনঘাট রউফ ও লেফটেন্যান্ট তাহের আখঞ্জি সালুটিকর, চালিতবাড়ি, জল্লারপাড় এলাকায় রেইড, অ্যামবুশ, টহল কার্যক্রম বাড়িয়ে দেন এবং গোয়াইনঘাটে যাতে রি ইনফোর্সমেন্ট না আসতে পারে তার ব্যবস্থা করেন।
চ. ১৫ নভেম্বর থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে এবং শত্রুরা মুক্তিবাহিনীর কিছু অবস্থান আক্রমণ ও শেলিং অব্যাহত রাখে। ২০ থেকে ২৪ নভেম্বর চারদিনই ঘোরা, দুয়ারীখেল, ছাত্তারগাঁও, লুনিগ্রাম, জাফলং চা বাগান, কাফাউড়া ও বাউবিবাগ অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনী উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বদিক থেকে পাকিস্তানীদের রাধানগর ও ছোটখেল অবস্থানকে অবরোধ করার যে প্রতিক্রিয়া করেছিল তা ২৪ নভেম্বর পূর্ণতা পায়। ২৬ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি শিমুলতলা গ্রামে রাধানগর-গোয়াইনঘাট সড়ক সামনে রেখে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। এর ফলে রাধানগরের সাথে শত্রুদের রিয়ার হেডকোয়ার্টারের যোগাযোগ বিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

ছ. ২৬ নভেম্বর রাতে ভারতীয় ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট রাধানগর ও ছোটখেল আক্রমণ করে। সুবেদার বদিউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল এই আক্রমণে অংশ নেয়। প্রচণ্ড যুদ্ধ শেষে গুর্খা রেজিমেন্ট ছোটখেল দখল করে। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩৬ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয় এবং বহু সৈন্য গুরুতরভাবে আহত হয়। কিন্তু মাত্র ছয় ঘন্টা পরে পাকিস্তানীরা ছোটখেলে পাল্টা আক্রমণ করে। গুর্খা রেজিমেন্ট পাকিস্তানী হামলার মুখে টিকতে না পেরে অবস্থান ছেড়ে চলে আসে এবং শত্রুরা ছোটখেল পুনর্দখল করে।
জ. গুর্খা রেজিমেন্টের ছোটখেল বিপর্যয়ের পর ছোটখেল দখলের পরিকল্পনা করা হয়। মিত্রবাহিনীর অনুরোধে ৫ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলী ইস্ট বেঙ্গলকে ছোট খেল দখলের নির্দেশ প্রদান করেন। মেজর শাফায়াত জামিল ও লেফটেন্যান্ট নবী একত্রে আক্রমণের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এখান উল্লেখ্য যে ডেল্টা কোম্পানির কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট নবী রাধানগরে ও ছোটখেলের যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়ে যে, লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবীর নেতৃত্বাধীন ডেল্টা কোম্পানি ছোটখেল আক্রমণ পরিচালনা করবে। পরবর্তী অধিনায়ক মেজর শাফায়ত জামিল নিজেই আক্রমণ পরিচালনার কথা জানান।
ঝ. পূর্ব নির্ধারিত স্থানে সঠিক সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সকল প্লাটুন পাকিস্তানীদের মোকাবেলা করার জন্য হাজির হলো। কমান্ডিং অফিসার মেজর শাফায়াত জামিল স্বয়ং এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবেন প্রথম সারিতে উপস্থিত থেকে, একথা জানার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বহুগুণে বেড়ে যায়।
ঞ. ২৮ নভেম্বর রাতে এই ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানির সৈনিকরা একসারিতে পাকা ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে চুপিসারে ৭০০/৮০০ গজ দূরে অবস্থিত শত্রু অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়ে লাগল। মেজর শাফায়াত বাম দিকের অংশে মাঝামাঝি এবং লেফটেন্যান্ট নবী ডান দিকের অংশের মাঝামাঝি থেকে নেতৃত্ব দেন। শত্রুর অবস্থান আর ৩০০ গজ সামনে, এমন সময় শাফায়াত জামিল চিৎকার করে উঠলেন ‘জয়বাংলা’। এক কণ্ঠ যেন সহস্র কন্ঠ হয়ে উচ্চারিত হলো। মুক্তিযোদ্ধারা অমিত বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকিস্তানীদের ওপরে।। ঘোরা গ্রামের ২টি মেশিনগান ও ১টি রিকয়েললেস রাইফেল গর্জে ওঠে। এক একজন মুক্তিযোদ্ধা যেন অসাধারণ শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। পাকিস্তানীদের সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা ছোটখেল দখল করে নিল।
ট. চারদিকে তখন রক্তের স্রোত, পাকিস্তানীদের লাশের স্তূপ ও ফেলে যাওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ। বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা মুক্তিযোদ্ধারা খড়ের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিল। প্রজ্বলিত আগুনে চারদিকে আলোকিত হয়ে উঠল। লেফটেন্যান্ট নবী পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া একটি নতুন স্টিল হেলমেট মাথায় দিয়ে দেখানোর জন্য মেজর শাফায়েতের কাছে দৌড়ে যান। মেজর শাফায়াত আনন্দে হাসলেন, ঠিক এই সময়ই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। খড়ে আগুন ধরানো অত্যন্ত ভুল হয়েছল, এই বোঝা গেল যখন পাকিস্তানীদের গুলিবর্ষনে মেজর শাফায়াত কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেলেন।
ঠ. মেজর শাফায়াতকে ভারতের তুরা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। আহত অবস্থান থেকেও তিনি তাঁর কর্তব্য ভোলেননি। লেফটেন্যান্ট নবীকে পাকিস্তানীদের বিতাড়িত করার জন্য তিনি চিঠি লিখলেন। সৈন্যদের উৎসাহিত করার পরামর্শ দিয়ে এই পত্রে পাকিস্তানীদের যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করার কথা তিনি লিখিত নির্দেশ দেন। মেজর শাফায়েত জামিল মুরা বস্তি, ইসলামপুর বস্তি, কুমিল্লা বস্তি ও রাধানগর দুল দখলের জন্য আক্রমণ করার নির্দেস দেন। এদিকে অধিনায়কের অর্বতমানে লেফটেন্যান্ট নবীকে ৩ ইস্ট বেঙ্গলের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। ড. অপারেশনাল কমান্ডার লেফটেন্যান্ট নবী রাধানগরের সকল অবস্থান শত্রুমুক্ত করার জন্য এলাকার সকল গণ ও নিয়মিত বাহিনীর কোপানি কমান্ডার এবং প্লাটুন কমান্ডারদের নির্দেশ দেন। ২৯/৩০ নভেম্বর রাতে লেফটেন্যান্ট মতিউর, মুজাহিদ, ক্যাপ্টেন দাউদ, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মনজুর, হাবিলদার রফিক, সুবেদার মোশাররফ তাদের কোম্পানি নিয়ে পাকিস্তানী ঘাঁটির ওপর হামলা চালায়।
ঢ. ২৯/৩০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে টিকটে না পেরে পাকিস্তানী সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে গোয়াইনঘাটে পালিয়ে যায়। সমগ্র রাধানগর কমপ্লেক্স মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। মুক্তিবাহিনীর সব কোম্পানি কমান্ডারগণ তখন রাধানগর ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে এক অপরকে জড়িয়ে ধরে বিজয়ের গভীর আনন্দে। মুক্তিযোদ্ধারা অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। আর এভাবেই এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে পাকিস্তানীদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি রাধানগর কমপ্লেক্সের পতন হয়। যুদ্ধের ফলাফল মুক্তিবাহিনীর হাতে রাধানগর পতনের পর পুরা ডাউকি সাব-সেক্টর শত্রুমুক্ত হয়। এটি ছিল অত্যন্ত সফল অপারেশন। ছোটখেল আক্রমণের ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্টের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। শুধু ছোটখেল আক্রমণে তাদের আনুমানিক ৩৬ জন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়। পাকিস্তান বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাদের অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে ৩০ নভেম্বর আক্রমণে তাঁরা নিজেদের অবস্থান ছেড়ে বিনা যুদ্ধে পিছনে চলে আসে।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!