You dont have javascript enabled! Please enable it!

রামগড়ের যুদ্ধ, পার্বত্য চট্টগাম

১ এপ্রিল, ’৭১-এ বিদ্রোহ ই পি আর বাহিনীর হালিশহর এবং ২ এপ্রিকট কোর্ট হিলের অবস্থান দু’টি পাকবাহিনীর দখলে চলে যাবার পর থেকে পুরো চট্টগ্রাম বন্দর নগরীটির পতন ঘটে। ৩০ মার্চেই পুরো বন্দুরনগরী চট্টগ্রাম একটি জন-মানবশূণ্য শহরে রূপ নিয়েছিল। এর মধ্যে অন্যান্য জেলার জনসাধারণ বিভিন্ন পথে নিজ নিজ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে শহর ত্যাগ করে যায়। ১ এপ্রিল থেকেই সীমান্ত সংলগ্ন ফেনী নদীর তীরে অবস্থিত তৎকালীন ছোট মহকুমা শহর রামগড় হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র। ফেনী নদীর অপর পাড়ে খুব নিকটেই ছিল ভারতীয় মহকুমা শহর সাবরুম। দু’টি মহকুমা ভিন্ন দেশের হলেও রামগড় এবং সাবরুমের জনগণ একে অপরের সাথে পরিচিত ছিল সুদীর্ঘকাল ধরে। ৩০ মার্চ বিদ্রোহী ই পি আর বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী ক্যাপ্টেন রফিক এবং ১ এপ্রিল বিদ্রোহী অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়াউর রহমান ভিন্ন ভিন্নভাবে সাবরুমে ভারতীয় বি এস এফ- এর কর্মকর্তাদের সাথে অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলা-বারুদ দিয়ে সাহায্য করার জন্য আবেদন করেন। বি এস এফ- কর্মকর্তাদের নির্দেশে ক্যাপ্টেন রফিক সাবরুম থেকে চলে যান আগরতলায়। এদিকে মেজর জিয়া সাবরুমে দেখা করেন ভারতীয় বি এস এফ এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান ব্রিগেডিয়ার পান্ডের সাথে। মেজর জিয়া এসময় কালুর ঘাট ব্রীজ এলাকায় অবস্থানকারী তার নেতৃত্বধীন বাহিনীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ওদিকে ক্যাপ্টেন রফিকের অনুপস্থিতিতে তাঁর নেতৃত্বধীন বিদ্রোহী ই পি আর বাহিনীর সদস্যরা যে সিও এবং এন সি ও-দের নেতৃত্ব যে যার মত প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ক্ষয়ক্ষতিও হয় ব্যাপক
২ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় ব্রিগেডিয়ার পান্ডের সাথে দেখা হয় মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশররফ ও মেজর শাফায়ত জামিলসহ কয়েকজন বিদ্রোহী সেনা অফিসারের সাথে। ঊর্ধ্বতন বিদ্রোহী সেনা অফিসারগণ সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় একটি কনফারেন্সে যোগ দেবার জন্য রামগড়ে অবস্থানরত মেজর জিয়াকে সংবাদ পাঠানোর জন্য ব্রিগেডিয়ার পান্ডকে অনুরোধ করেন। ওদিকে আগরতলা-সংলগ্ন কোনাবাদ এলাকায় ঢাকা শহর থেকে ২ এপ্রিল পালিয়ে আসা কর্নেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানী এম এন এ-কে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়ায় নিয়ে আসেন। ৪ এপ্রিল উর্ধতন বিদ্রোহী সেনাকর্মকর্তাদের ‘ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া কনফারেন্স’ মেজর খালেদ মোশররফ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধরত বিদ্রোহী সৈনিকদের কমান্ডচ্যানেল নিয়ে আসা এবং সমন্বিত এ্যাকশনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাছাড়া সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধটিকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধেরর সাথে সম্পৃক্ত না করতে পারলে পুরো ব্যাপারটি একটি ‘সেনা বিদ্রোহ’ হিসেবে পাকিস্তানীরা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার যথেষ্ট সম্ভবনা ছিল। তাছাড়া নির্বাচতি গণ প্রতিনিধিদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত না করতে পারলে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতেও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে বলে মেজর খালেদ মোশাররফ বক্তব্য রাখেন। উপস্থিত সেনা কর্মকর্তাগণ মেজর খালেদের মতামতের সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করেন। তেলিয়াপাড়া কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্নেল ওসমানীকে দায়িত্ব দেয়া হয় সীমান্ত অতিক্রমকারী গণ-প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে শীঘ্রই একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের। কমান্ড চ্যানেল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পুরো দেশটিকে ৯টি অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলের দায়িত্ব একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারকে সমন্বিত সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যাবার দায়িত্ব দেয়া হয়। তেলিয়াপাড়া কনফারেন্সে উপস্থিত সামরিক অফিসারদের মধ্যে ছিলেন কর্নেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানী এম এন এ, লেঃ সালাহ উদ্দিন মোহাম্মদ রেজা, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর শাফায়ত জামিল, মেজর নুরুল ইসলাম এবং মেজর মইনুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ। এই তেলিয়াপাড়া কনফারেন্সে ফলশ্রুতিতেই ১০ এপ্রিল জাতির উদ্দ্যেশে এক বেতার ভাষণে জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ আহমেদ এম, এন এ শিলিগুড়ি বেতারকেন্দ্র থেকে একটি প্রবাসী বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয়েছিল। ১০ এপ্রিলের ঐ বেতার ভাষণে জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধরত সামরিক অফিসারদের নাম এবং তাঁদের নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকারও ঘোষণা দেন। তেলিয়াপাড়া কনফারেন্স সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে। ব্রিগেডিয়ার পান্ডের অনুরোধে এবং তেলিয়াপাড়া কনফারেন্সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চট্টগ্রাম শহরটি পুনর্দখলের জন্য ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি এবং ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ঐদিন সন্ধ্যার মধ্যেই রামগড়ের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কোম্পানি দু’টি ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে কয়েকশ মাইল পাহাড়ী রাস্তা পেরিয়ে ৫ এপ্রিল রাতে রামগড়ে গিয়ে পৌঁছে। ৬ এপ্রিল ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বাধীন কোম্পানিটিকে রামগড় হোয়াক-করইরহাট-বারইয়ার হাট- মিরেশ্বরাই ও সীতাকুন্ড হয়ে বাটিয়ারীতে অবস্থানরত ই পি আর বাহিনীর সাহায্যের্থে তাৎক্ষণিকভাবে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বাধীন কোম্পানিকে হোয়াকু-নারায়ন হাট, ফটিকছড়ি, নাজির হাট, হাজারী হয়ে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট এলাকার নিকটেই অবস্থানরত ই পি আর বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে যোগ দিতে বলা হয়। তেলিয়াপাড়া কনফারেন্স থেকে ফিরে এসে রামগড়ে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে মেজর জিয়া বিদ্রোহী সামরিক বাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর , পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদেরকে একটি কমান্ডচ্যানেলে ফিরিয়ে এনে সমন্বিত এ্যাকশনে যাবার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ভারতীয় বি এস এফ-এর কাছ থেকেও এরই মধ্যে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা-বারুদ পাওয়া গেল। ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বাধীন কোম্পানিটি নাজিরহাট পৌঁছাতেই সংবাদ পায় যে, পাক-বাহিনীর আক্রমণের প্রচণ্ডতায় টিকতে না পেরে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট এলাকা সংলগ্ন প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে ই পি আর সৈন্যরা হাটহাজারী এলাকায় পিছু হটে এসেছে। অগত্যা ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বাধীন বেঙ্গলের কোম্পানিটি নাজির হাট সংলগ্ন উদালিয়া চা বাগান এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। ১১ এপ্রিল ক্যাপ্টেন হারুনের নেতৃত্বাধীন ই পি আর এবং মেজর শওকতের নেতৃত্বাধীন অষ্টম বেঙ্গলের কালুর ঘাট ব্রীজ এলাকার প্রতিরক্ষা অবস্থানের পতন ঘটলে বিদ্রোহী বাহিনী কাপ্তাই রাঙামাটি হয়ে মহলছড়িতে গিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। কালুর ঘাটের পতনের ফলে পাকবাহিনীর পক্ষে চট্টগ্রাম শহরের বাহিরে আক্রমণ চালানোর শক্ত প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত হয়। অস্ত্রবল তো আগে থেকেই সোয়াত জাহাজে করে নিয়ে আসা হয়েছিল। ১১ এপ্রিলে পাকিস্তানীদের একটি শক্তিশালী দল কর্নেল হাট-ভাটিয়ারী হয়ে সীতাকুন্ডের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। দ্বিতীয় দলটি কালুরঘাট ও কাপ্তাই হয়ে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। তৃতীয় শক্তিশালী দলটি হাটহাজারী-নাজিরহাট হয়ে নারায়নহাটের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানীদের প্রতিটি অগ্রগ্রামী সেনাদলই ব্যাপক আর্টিলারী এবং মর্টার ফায়ার সাপোর্ট নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়ক হয়ে অগ্রসরমান পাকবাহিনীর শক্তিশালী দলটি ভাটিয়ারী ও কুমিরায় বিদ্রোহী ই পি আর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে অনেকগুলো খন্ডযুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিদ্রোহী বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও এ্যামুনিশনের অপ্রতুলতার কারণে তাদেরকে ধাপে ধাপে পিছু হটতে হয়। ১৬ এপ্রিল পাকিস্তানীরা সীতাকুণ্ড দখল করে নেয়। বিদ্রোহী বাহিনী পিছু হটে গিয়ে মিরেশ্বরাই এবং বারইয়ার হাটে গিয়ে অবস্থান নেয়। ২৫ এপ্রিল বারইয়ার হাটেও পতন ঘটে। বিদ্রোহ ই পি আর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা পিছু হটে হেয়াকুবাজার এলাকায় গিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। বিদ্রোহী বাহিনীর অন্য একটি দল শুভপুর ব্রীজ এলাকায় গিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। উদ্দেশ্য, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে রি-ইনফোর্সমেন্ট আনার চেষ্টা বাধা দেয়া। এরই মধ্যে পাকিস্তানীরা জেনে গিয়েছিল যে, রামগড়ে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে বিদ্রোহী বাহিনী অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছিল। আর তাই রামগড় দখলের জন্য পাকিস্তানীরা মরিয়া হয়ে তিন দিক থেকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কাপ্তাই-রাঙামাটি হয়ে পাকবাহিনীর যে দলটি অগ্রসর হচ্ছিল, তারা ২৭ এপ্রিল বিদ্রোহী বাহিনীর মহলছড়ি অবস্থানের উওর দু’টি মিজো ব্যাটেলিয়ন এবং কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে মুক্তিবাহিনীর মহলছড়ি অবস্থানের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে বসে। মেজর মীর শওকতের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী শত্রুর বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে যায়। এক পর্যায়ে তরুণ দুঃসাহসী অফিসার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের গুলিবৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ে অবস্থান নেন। নতুন অবস্থানে পৌঁছে সঙ্গী দু’জন ই পি আর সৈনিকদের নিয়ে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের অনবরত পাকিস্তানী বাহিনী এবং মিজোদের উপর এল এম জি’র গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। সংঘর্ষ চলার এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর নিক্ষিপ্ত ৩টি গুলি তাঁর বা হাট বা বগলের নিচে বিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায়ও ক্যাপ্টেন কাদের এক হাতের সাহায্যেই এল এম জি’টি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ততক্ষণে নিজ বাহিনীর সদস্যরা শত্রুর বেষ্টনি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাঁর সঙ্গী ছাত্র শওকত ও ফারুক ক্যাপ্টেন কাদেরকে কাঁধে করে পাহাড় বেয়ে নিচে নামিয়ে আনেন। ই পি আর এর সৈনিক সিপাহী আব্বাস হাজারো গুলি-গোলার মধ্যেই আহত ক্যাপ্টেন কাদেরকে জীপে করে রামগড়ের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেন। তখনও ক্যাপ্টেন কাদেরের দেহে প্রাণ ছিল। রামগড়ে পৌঁছার পর দেখা গেল যে, ক্যাপ্টেন কাদেরের দেহ থেকে তাঁর প্রাণপাখিটি পথিমধ্যে উড়ে গেছে। ক্যাপ্টেন কাদেরের মৃতদেহ যথাযথ সামরিক রীতিতে রামগড়ের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। সম্ভবতঃ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরই হচ্ছেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ অফিসার। শত্রুর বেষ্টনি থেকে বেরিয়ে মেজর শওকতের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ৩০ এপ্রিল রামগড়ে পৌছতে সমর্থ হয়। মহলছড়ির পতনের পর শত্রু বাহিনীও মহলছড়ি-খাগড়াছড়ি-নাজিরাহাট হয়ে পাকবাহিনীর যে সেনাদলটি অগ্রসর হচ্ছিল, তাদেরকে প্রতহিত করাও বিদ্রোহী বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ধাপে ধাপে মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা পিছু হটে নারায়ণহাটে গিয়ে অবস্থান নেয়। এই পথেও শত্রু বাহিনীর সাথে অনেকগুলো খন্ডযুদ্ধ হয়। দু’পক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ওদিকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে কোন কিছু বিনিময়ে রামগড়কে রক্ষা করার নির্দেশ আসে। কিন্তু ততদিনে সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে রামগড় হাইস্কুল প্রাঙ্গণে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক কমপক্ষে ৫০০ ছাত্র ও যুবকের সামরিক প্রশিক্ষণদানের পর এদেরকে সম্মুখ রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে ইচ্ছুক আরো কয়েকশ ছাত্র ও যুবক একত্রিত হয়েছিল। চারদিকে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যাওয়া, প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতা এবং প্রয়োজনীয় রেশনের অভাবে এদের প্রশিক্ষণদানের কাজ সমাপ্ত করা যায় নি, ছোট শহর বলে রামগড় শহরে স্বচ্ছল লোকজনেরও অভাব ছিল। মহকুমা শহর হলেও এটা একটি সাধারণ গ্রাম্য বাজারের মতই ছিল। রামগড় শহরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য একটি হাসপাতালও খোলা হয়েছিল। ১ এপ্রিল থেকেই জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে এই শহরের মূল বাসিন্দাদের চেয়ে শরণার্থীদের সংখ্যা হয়ে যায় দশগুণ। নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছুরই অভাব দেখা দিয়েছিল। ২৮ এপ্রিল বারিয়ার হাট-করইহাট হয়ে পাকিস্তানিদের একটি শক্তিশালী সেনাদল হেয়াকু বাজারের কাছাকাছি পৌঁছে অবস্থান নিয়ে নেয়। হেয়াকুর পতন তখন সময়ের ব্যাপার ছিল। ২৯ এপ্রিল সকাল থেকেই পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর হেয়াকু অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে। দিনভর অনেকগুলো খণ্ডযুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিদের আক্রমণের প্রচণ্ডতায় শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী ধাপে ধাপে হেয়াকু থেকে পিছু হটে চিকনছড়া নামক স্থানে গিয়ে অবস্থান নেয়। হেয়াকুর পতনের পর রামগড়ের প্রতিরক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। হেয়াকুর পতনের ফলে হাজার হাজার শরণার্থীদের রামগড় হয়ে ভারতে যাবার রাস্তাও এদিন থেকে বন্ধ হয়ে যায়। তখন বিকল্প পথ থেকে যায় মানিকছড়ি-ডানছড়ি হয়ে রামগড়ে পৌঁছানো।
রামগড়ের পতন অত্যাসন্ন ভেবে ইতোমধ্যেই মেজর জিয়াউর রহমান ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ভারত সীমান্তের ছ’মাইল অভ্যন্তরে হরিনায় একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। ৩০ এপ্রিল থেকেই রামগড় থেকে প্রয়োজনীয় সব সামরিক ও বেসামরিক জিনিসপত্র এবং অস্থায়ী হাসপাতালটি হরিনায় স্থানান্তরের কাজ শুরু হয়ে যায়। রামগড় রক্ষার জন্য ৩০ এপ্রিল রাতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পুনরায় নির্দেশ আসেঃ ‘বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রামগড়ের রক্ষা কর’।
প্রয়োজনীয় অস্ত্র-শস্ত্র ও জনবলের ব্যবস্থা না করে রামগড়ে রক্ষার এই নির্দেশ ছিল অবাস্তব। কেননা ততক্ষণ পরিবর্তত অবস্থান চিকনছড়া থেকেও মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সরিয়ে রামগড়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। মহলছড়ি থেকে মেজর শওকতের নেতৃত্বাধীন বাহিনিটিও এদিন রামগড়ে এসে পৌঁছলে তাদেরকে শহরের আশপাশের টিলাগুলিতে অবস্থান নিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
১ মে সকাল থেকেই পাকিস্তানিরা রামগড়ের আশপাশের এলাকায় ব্যাপক আর্টিলারীর শেলিং শুরু করে। প্রবাসী সরকারের নির্দেশ পেয়ে রামগড়কে রক্ষার জন্য এদিন ব্যাপক শেলিং এর মধ্যেও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রামগড় শহরকে কেন্দ্র করে নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান সাজিয়ে তোলে। ওদিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা যাতে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়তে না পারে সেজন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দলও সাবরুমে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী সাবরুমে এসে অবস্থান গ্রহণের ফলে স্বাধীনতাকামী জনগণ এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মনোবল শতগুনে বেড়ে যায়। ২ মে সকাল পাকিস্তানিরা রামগড়ের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে বসে। আর্টিলারীর শেলিংয়ের ফায়ার কভারে এগিয়ে এসে তারা করেরহাট-রামগড় রাস্তাকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙ্গে দেয়। ট্যাংক-বিধ্বংসী অস্ত্রের গোলার সরাসরি আঘাতে বাঙ্কারগুলো ধসে পড়েতে থাকে একের পর এক। কামানের ‘স্মোক শেল’ নিক্ষেপ করে পাকিস্তানিরা পাহাড়সমূহ এবং রামগড়ের মাঝের এলাকা ধূম্র-জাল সৃষ্টি করে। সেই ধূম্র-জালের আড়ালে তাঁদের দ্বিতীয় দলটি ‘ এ্যাস্নট ফরমেশ্নে’ দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকে রামগড়ের মধ্যবর্তী অবস্থানসমূহের দিকে। সন্ধ্যার ঘন্টাখানেক আগে পাকিস্তানিদের একটা পুরো ব্যাটেলিয়ন রামগড়ের মধ্যবর্তী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানসমূহ দখল করে নেয়। এরপর শত্রুবাহিনী রামগড়ের কেন্দ্রস্থলের দিকে এগুতে থাকে। পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরও মুক্তিবাহিনীর সৈনিকেরা গোলাগুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত অগ্রসরমান পাকিস্তানিদের উপর গোলা ও গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার পর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নদী পার হয়ে ভারতের সাবরুমের এলাকায় পশ্চাদপসরণ করে। পতন হয় রামগড়ের। রামগড়ের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অসংখ্য সৈন্য হতাহত হয়। এদের অনেককেই দাফন করাও সম্ভব হয় নি। রামগড়ের বিভিন্ন টিলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল এসব শহীদের মৃতদেহ। পরবর্তী ক’দিন এসকল শহীদের অসাড়দেহ সম্ভবত শিয়ালের খাদ্যই হয়েছিল। আমাদের এই প্রিয় স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনীর হাজার হাজার সৈনিক এভাবেই নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন। প্রতিদানে তাঁরা কোন স্বীকৃতি পাননি।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!