You dont have javascript enabled! Please enable it! রাজাপুরের যুদ্ধ, বরিশাল - সংগ্রামের নোটবুক

রাজাপুরের যুদ্ধ, বরিশাল

১৯৭১ সালে রাজপুর ছিল ঝালকাঠি মাহাকুমার একটি থানা। এই থানাতি বরিশাল জেলার মোটামুটি একটি প্রত্যন্ত এলাকার থানা। বরিশাল থেকে নৌপথে ঝালকাঠি হয়ে রাজপুর যেতে হতো। প্রত্যন্ত অঞ্চল হলে কি হবে সে সময় রাজপুর থানায় ছিল পাকা দালান ও শক্ত ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি। রাজপুর থানায় সে সময় পুলিশ ছিল, রাজাকার ছিল আর ছিল বদর বাহিনী। এই বদর বাহিনীর অত্যাচারে আশেপাশের জনগন ছিল অতিষ্ঠ। রাজাকার আর বদর বাহিনী মিলে লুঠরাজ চালাত প্রায়ই দিনই। বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বসতবাড়িতে। ফলে অঞ্চল ছাড়া হয়েছিল প্রায় সকল হিন্দুরাই। বরিশাল ও পটুয়াখালী সাব সেক্টর কমান্ডর ক্যাপ্টেন শাহাজান ওমরের বাড়ি ছিল ঐ রাজাপুর থানায়। ক্যাপ্টেন ওমর নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিকল্পনা করেন রাজপুর থানা আক্রমণের। থানা দখল করে বদর বাহিনীর হাত থেকে এলাকাবাসী কে বাঁচানোর জন্য। ঐ সময় রাজপুর থেকে সাত মাইল দূরে আতাভিম্রুল গ্রামে গোপন আশ্রয়ে ছিল আব্দুল হাই পনের মুক্তিযোদ্ধার দল। ক্যাপ্টেন ওমর ঐ দলকে সংগে নিয়ে দুদিক থেকে একসাথে থানা আক্রমণের প্লান করলেন। ক্যাপ্টেন ওমর আক্রমণের দিন, সময় পনার দলের কাছে জানাবার জন্য একজন লোক পাঠিয়ে দিলেন। সে সময় আব্দুল হাই পনা ক্যাম্পে চলেন না। তিনি আর একটা অপারেশনের জন্য অন্যত্র গিয়েছিলেন। তখন ক্যাম্পের দায়িত্বে চিলেন দলের সেকেন্ড ইন কমান্ডার জমির উদ্দিন নান্না। তিনি বললেন ৮০ জনের মতো মুক্তি যোদ্ধা নিয়ে আতাভিম্রুল গ্রামে হাইড আউট এ আছি। যে দিন ক্যাপ্টেন ওমরের নিকট থেকে থানা আক্রমণের খবর এলো তখন আমাদের দলের কমান্ডার পনা চলে গিয়েছিল অন্য একটা অপারেশনে। আমি যখন আমাদের সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ওমরের কাছ থেকে রাজপুর থানা আক্রমণের আদেশ পাই তখনই ৬০ জনের মতো সাহসী মুক্তিযোদ্ধার একটি দল আসন্ন আক্রমণের জন্য তৈরি করি। আমি জানতে পারলাম ক্যাপ্টেন ওমর নলছিটি ও ঝালকাঠি বর্ডার এলাকায় এক গোপন আশ্রয়ে আছেন এবং সেখান থেকে তিন আসবেন থানা আক্রমণে। এটি হবে একটি সম্মিলিত আক্রমণ এবং শুরুর সময় ছিল ভোর বেলায়। আমাদের ক্যাম্প থেকে রাজাপুর প্রায় সাত মাইল দূরে অবস্থিত। যেতে হবে নৌপথে। আমাদের সাথে ছিল তিনটি লম্বা বাইছের নৌকা। বরিশালের ভাষায় বলা হয় “টালাই নৌকা। এক এক নৌকাতে ১৮/২০ জন বসতে পারে। একজন থাকে হাল ধরে বাকি সবাই বৈঠা মারে। পানির উপর দিয়ে লঞ্চের চেয়েও দ্রুতবেগে এই “টালাই” নৌকা চলতে পারে। রাতের খাবার খেয়ে আমরা সবাই তৈরি হলে নিলাম। সবার কাছে অস্ত্র ছাড়াও আছে একটি করে নৌকা চালানোর জন্য বৈঠা। নভেম্বর মাসের শীতের রাত। হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা পুরো এলাকা। আমরা সবাই তিনটি নৌকা নিয়ে রওনা দিলাম। আতাভিমরুল থেকে গাবগখান নদীর ভিতর দিয়ে যখন ধানসিঁড়ি নদীতে এসে পড়লাম তখন রাত দুটো। আর মাত্র এক ঘণ্টার পথ। চারদিকে নিশুভ নিস্তব্ধ পরিবেশ। রাতের শেষ প্রহরে আমরা শুক্তাঘর বাজারে পৌঁছে গেলাম। এই শুক্তাঘর বাজার থেকে মাত্র দেড়মাইল দূরেই রাজাপুর থানা, আমাদের আজকের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। অতি সাবধানে সবাই আমরা নৌকা থেকে নামলাম। আমি এখান থেকে আমাদের সঙ্গে আসা ক্যাপ্টেন ওমরের সংবাদবাহককে গোপন রাস্তা ধরে পাঠিয়ে দিলাম ক্যাপ্টেন ওমর নিকটে। যাতে করে ক্যাপ্টেন ওমর জানতে পারে তার প্লান মোতাবেক আমরা এসে গেছি। গ্রামের ভিতর এবং বাইরে ফাঁকা ভিটায় পানের বরোজ। আমরা সবাই একলাইনে অতি সন্তর্পণের সঙ্গে ধীরে গতিতে পানের বারোজগুলোর আড়ে আড়ে এগিয়ে চলছি। একটু পরেই আমরা রাজাপুর বাজারের একেবারে নিকটে পৌঁছে গেলাম। রাজাপুর থানা এই বাজারের মাঝখানেই অবস্থিত। থানার সামনে মেইন রাস্তা বারবার রাজাপুর হাইস্কুল। আমাদের জানামতে এবং আক্রমণের প্ল্যান মোতাবেক ক্যাপ্টেন ওমর স্কুলের পূর্ব পাশ দিয়ে প্রথমে আক্রমণ করবে। তার আক্রমণের আওয়াজ পেলেই আমরা আক্রমণ করব। এবার আমরা উত্তরমুখী হয়ে এগোতে লাগলাম। থানা ছিল উত্তরমুখী। একজন একজন করে আমরা পজিশনে গেলাম। আমরা সবাই যখন পজিশনে চলে গেছি তখন ভোর হয় হয়। একটু পরেই ফজরের আজান পড়বে। রাস্তায় দেখা যায় দু’চারজন মুসল্লি মসজিদের দিকে যাচ্ছে। পজিশনে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছি ক্যাপ্টেন ওমরের গুলির শব্দের জন্য। হঠাৎ করে সকল নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে গুড়ুম, গুড়ুম শব্দে গুলির শব্দ ভেসে এলো। আক্রমণ করেছে ক্যাপ্টেন ওমর। সাথে সাথে আমরাও শুরু করলাম থানা লক্ষ্য করে গুলি। এই আক্রমণে প্রথম হকচইক্যে গেল থানার পুলিশ, রাজাকার ও বদর বাহিনী। রাজাপুর থানা ছিল বাঙ্কার দিয়ে তৈরি বদর বাহিনীর একটি সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা পজিশন। তারাও সাময়িকভাবে আক্রমণের সারপ্রাইজ কেটে উঠে পাল্টা ফায়ার শুরু করল। সুরক্ষিত বাঙ্কার পজিশন নিয়ে ওরা আমাদের আক্রমণের জবাব দিতে লাগল। শুরু হয়ে গেল দ’পক্ষের তুমুল যুদ্ধ। বেলা প্রায় ১২টার সময় থানার সকলে মাথার উপরে হাট তুলে আত্মসমর্পণ করল। রাজাপুর থানা আমাদের দখলে চলে আসছে। থানা দখলের পর জানতে পারলাম, ক্যাপ্টেন ওমরের পায়ে গুলি লেগেছে। আমাদের পক্ষে আর কেউ আহত বা নিহত হয়নি। উড়িয়ে দিলাম আমরা স্বাধীন বাংলার পতাকা রাজাপুর থানাতে। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন ওমর অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বন্দিদের নিয়ে চলে যায় তার ক্যাম্পে, আমরাও ফিরে আসি আমাদের ক্যাম্পে।
[১৪৭] হামিদুল হোসেন তারেক

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত