রূপসী বাজার অপারেশন, রূপগঞ্জ
রূপগঞ্জ থানার শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রূপসী বাজারের অবস্থান। ২৩ আগস্ট সকাল ৯টায় রূপ্সী বাজার যখন ক্রেতা বিক্রেতায় ভরপুর এমনি এক সময়ে চারটি ক্ষুদ্রাকৃতি জলযানযোগে পাকিস্তানী সেনাদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি দল রূপসী বাজারের দক্ষিণ মধ্য প্রান্তের শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বতীরে রূপসী বাজারে কমান্ডো স্টাইলে লাফিয়ে নেমে পড়ে। এই সেনাদলের সদস্যরা দুই লাইনে বিভক্ত হতে দেখে বাজারে অবস্থানরত জনসাধারণ ছুটাছুটি শুরু করলে পাকিস্তানীরা আঃ রহমান, শাহাজাহান ভূঁইয়া, কবীরউল্লাহ, টুকু মিয়াসহ বেশ কয়েকজন ধরে নিয়ে যায়। অপর একটি দল বাজারে অগ্নিসংযোগ এবং মালামাল লুটতরাজ ক্রএ এবং অবস্থানরত জনসাধারণ জিম্মি করে মালামাল বোটে তুলতে থাকে। অপর দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত রূপসী বাজারের পূরব পার্শ্বে অবস্থানরত পারভেজের (খসরু) দল সন্তর্পণে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য দ্রুত তৈরি হতে থাকে। ক্রলিং করতে করতে খসরুর দল বাজারের দক্ষিণ পার্শ্বে কলমমাঝির বাড়ির কলাবাগানের পেছনের যেয়ে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে এলএমজি বসিয়ে শত্রু ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে। এ সময় পারভেজের পেছনে আরও এলএমজি নিয়ে প্রস্তুত থাকে মুক্তিযোদ্ধা রুমী। ইতোমধ্যেই শত্রু সমগ্র বাজার এবং আঃ মোতালিব খাঁনের রাইস মিলটি সম্পূর্ণভাবে অগ্নিসংযোগ করে ভস্মিভূত করে দেয়। শত্রু ক্যাম্পে ফেরার পথে শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরে উদ্দেশ্যহীনভাবে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করতে থাকলে নিন্মোক্ত ব্যক্তিগণ গুলি ও সেলের আঘাতে শাহাদাৎ বরণ করেন (১) আমির আলই, পিতা মৃত শহর আলী, গ্রাম গন্ধর্বপুর। (২) এমরান মিয়া, পিতা মৃত সৈয়দ আলী, গ্রাম রূপসী। (৩) আমু প্রধান, পিতা মৃত পারব আলই, গ্রাম রূপসী। (৪) টুক্কু, পিতা মৃত পোড়াই বেপারী, গ্রাম রূপসী। (৫) রমিজ উদ্দিন, পিতা মৃত সাহাজ উদ্দিন, গ্রাম গন্ধর্বপুর। কমলমাঝির বাড়িতে অপেক্ষারত কমান্ডার খসরু ও তার অন্যতম সহযোগী রুমী গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে দৃষ্টি রাখে শত্রু বহনকারী জলযানগুলো ফিরে আসার দিকে। ২/৩ মিনিটের মধ্যেই দেখা গেল দুর্বৃত্তদের জলযানগুলো রূপসী বাজার বরাবর শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে পূর্ব গ্রামের প্রায় চর ঘেঁষে তাদের গন্তব্যস্থান লতিফ বাওয়ানী জুটি মিলের ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে। খসরু ও রুমী রেঞ্জের আওতায় আসার অপেক্ষায় ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে তাকিয়ে থাকে শত্রুর ৪টি জলযানের দিকে। ততক্ষণে পূর্ব গ্রামের চরের তীর ঘেঁষে শত্রু বহনকারী জলযানগুলো এলএমজি’র পুরো আওয়াত এসে পড়লে গর্জে ওঠে তাদের এলএমজিসহ সব হাতিয়ার। এই ব্রাশ ফায়ারে জলযানগুলো নদীর মধ্যে ঘোরপাক খেতে থাকে। এ অবস্থায় জলযান বহর থেকে শিলাবৃষ্টির মতো নদীর উভয় তীরে গোলাবর্ষণ করতে করতে শীতলক্ষ্যার বুক চিরে শত্রু বাওয়ানী ক্যাম্পের দিকে চলে যায়। পরবর্তীতে ডেমরা বালুঘাটে জলযানগুলো ভিড়ার সাথে সাথে দেখা গেল একটি সেনাবাহিনীর অ্যাম্বুলেন্স অপেক্ষমান। শত্রু বহনকারী জলযান থেকে ৫ জন মৃত এবং ১২ জন আহত সেনাকে তুলে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি রওয়ানা হয়ে গেল ঢাকা অভিমুখে। এ সময় নদীর ঘাটে শত শত শ্রমিক এ দৃশ্য অবলোকন করে। মাত্র ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা ৪টি শত্রুর বোট আক্রমণ করে হঠাৎ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে। প্রথাগত যুদ্ধের কোনো নিয়মের মধ্যে না পড়েলেও ছেলেরা অদম্য সাহস ও দৃঢ়চিত্তের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছে এ যুদ্ধে। নিজেদের কোনো ক্ষতি হয়নি। এ ধরনের ছোট ছোট যুদ্ধই শত্রুকে তাদের অবাধ বিচরণ থেকে বিরত রাখে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত