You dont have javascript enabled! Please enable it!

যশোর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর পাকবাহিনীর আক্রমণ

পাকবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন শার্শা থেকে পোতাপাড়া হয়ে লাউতলা দিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। পথিমধ্যে তাঁরা লাউতলার আমবাগানে তাদের সমাবেশ এলাকা করে এবং আরো সামনে এসে অবস্থিত একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রোল সর্বপ্রথম শত্রুর ওপর ফায়ার হানে। এতে পাক আক্রমণ কিছু সময়ের জন্য স্থাগিত হয়ে যায়। পাকবাহিনী পাল্টা ফায়ার করে এবং তাদের পিছু ধাওয়া করে। মুক্তিবাহিনীর কেউ কেউ ধরা পড়ে এবং পাকবাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণ করে। ২৩-২৪ এপ্রিল রাত ৪তা থেকে প্রচণ্ড আর্টিলারি গোলাবর্ষণের সাহায্যে নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী কাগজপুকুর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর হামলা পরিচালনা করে। পাকবাহিনী তাদের এ হামলায় মেইন রোড ব্যবহার না করে যশোর-বেনাপোল সড়কের উত্তর দিকে পান্থাপাড়া, ভুজতলা এবং দক্ষিণ দিকে অবস্থিত গয়রা, কাগমড়া এলাকাসমূহ দিয়ে দুদিক থেকে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ পরচালনা করে। মূলত উত্তদ দিকের পান্থাপাড়া এলাকা থেকে প্রথমে তাঁরা গ্রুপ অ্যাটাক করে এবং দক্ষিণ দিক থেকে পরিকল্পিত আক্রমণ করে। কাগজপুকুর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর বামের প্রতিরক্ষা অবস্থান প্রায় কোনো রকম প্রতিরোধ স্থাপন না করেই পিছু হটতে বাধ্য হয় কিন্ত ডানের প্রতিরক্ষা অব অবস্থান প্রাকৃতিক সুবিধা এবং আড়াল থাকার কারণে মোটামুটি সুবিধাজনক অবস্থান থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে। কাগজপুকুর বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণ দিকে রেলওয়ে সিগন্যালম্যানের গুমাটি ঘরের উপরেই ছিল একটি এমজি। এই ভাইটাল পজিশন থেকে এমজি নিয়ে এমজিম্যানের কাছ থেকে এমজি ছিনিয়ে নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে অগ্রগামী শত্রুর ওপুর ফায়ার করতে থাকেন। রেলওয়ে সিগন্যালম্যানের গুমটি ঘরের অবস্থান ছিল কিছুটা উঁচু জায়গায়, যার কারণে নায়েব সুবেদার মুজিবুল হক উঁচু অবস্থানে থেকে আগ্রগামী শত্রুর ওপর ফায়ার করতে সুবিধা পান। যুদ্ধের এই অবস্থায় মেজর ওসমান তাঁর একটি ১ টন ডজ গাড়িতে করে ৩ ইঞ্চি মর্টারগুলো পাঠিয়ে দেন যুদ্ধরত সৈনিকদের ফায়ার সহায়তা প্রদানের জন্য। তাঁরা কিছুটা অগ্রসর হয়ে সুবিধাজনক স্থানে পজিশন নিয়ে শত্রুর ওপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। চতুর হানাদার বাহিনী ইপিআরের পোশাক পরে ভোর ছয়টায় মুক্তিবাহিনী দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করে। তাদের এই চাল মুক্তিবাহিনী ধরতে ব্যর্থ হয়। কাছাকাছি আসার পর মুক্তিবাহিনী তা বুঝতে পারে এবং পাল্টা আক্রমণ চালায়। এদিকে নায়েব সুবেদার মুজিবুল ইসলাম হক একটি মাত্র এমজি দিয়ে তীব্র ফায়ারের মাধ্যমে শত্রুর অগ্রযাত্রা প্রায় ব্যাহত করে দেয়। কিন্তু যেহেতু এমজির অবস্থানটি অন্যান্য অবস্থান থেকে কিছুটা দূরে ছিল সে জন্য মজিবুল হক শত্রুর চতুরতা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে। মুক্তিবাহিনীর এই প্রতিরক্ষা অবস্থানে কারো সাথে কারো যোগাযোগ করার জন্য কোনো ফিল্ড টেলিফোন বা ওয়্যারলেস ছিল না। যারা ফলে কখন কোথায় কী ঘটছে সে ব্যাপারে সবাই অজ্ঞ ছিল। মুজিবুল হকের ফায়ারে যখন শত্রুরসেনা প্রায় বিধ্বস্ত তখন শত্রুর প্রায় ১ প্লাটুন সেনাদল ইপিআরের পোশাক পরে এমজি পজিশনের দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হয়। নায়েব সুবেদার মুজিবুল তাদের নিজস্ব বাহিনী মনে করে তাদের ওপর ফায়ার করা থেকে বিরত থাকেন। শত্রু আরো কাছাকাছি এলে তিনি বুঝতে পারেন কিন্তু ততক্ষণে যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট এসে সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়েব সুবেদার মুজিবুল হকের দেহ ঝাঁঝরা করে দেয়। পাশে থাকা প্রকৃত এমজিম্যান অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় এবং পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর প্রায় ৫০ জন এবং মুক্তিবাহিনীর ১৫ জন শহীদ হয়। নায়েব সুবেদার মুজিবুল হকের বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মুজিবুল হকের মৃত্যুর সাথে সাথে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর মর্টার বাহিনীর মর্টার গুটিয়ে গাড়িতে করে পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করে কিন্তু অল্প দূরে শত্রু সৈন্যদের অবস্থান দেখতে পেয়ে ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাস্তার আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে পেছনে পালিয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে মর্টার বাহিনীর কমান্ডার সুবেদার মোমিনুল হকও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেন। গাড়ি ও মর্টার শত্রুর হস্তগত হয়।
নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থানঃ কাগজপুকুর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পশ্চাদপসরণ করে মুক্তিবাহিনী প্রথমে কলোনির পেছনে আম বাগানে সমবেত হয়। তারপর নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তোলে। বেনাপোল সীমান্তের কাছাকাছি কাস্টমস কলোনির ঠিক পেছনেই এবার প্রতিরক্ষার সামনে দুটি ইস্ট বেঙ্গল কোম্পানি। বেনাপোল চেকপোষ্টের এক মাইল পেছনে রেখে দৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যূহ স্থাপন করা হয়। এপ্রিলের শেষ তিন দিন এবং মে মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর পাকবাহিনী গোলন্দাজ সহায়তা নিয়ে বারবার আক্রমণ চালায় কিন্তু তাদের প্রতিটি আক্রমণই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যায়। পাক হানাদার বাহিনী ইত্যবসরে দেশের প্রায় সকল প্রধান শহর ও সীমান্তে চৌকিসমূহ দখল করে ফেললেও বেনাপোল সীমান্তের কাছাকাছি ২ বর্গমাইল এলাকা ছিল শত্রুমুক্ত। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত পাকবাহিনী বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও উক্ত ১ বর্গমাইল এলাকা দখল করতে পারেনি।
পাকবাহিনী প্রতিরক্ষাঃ কাগজপুকুরে আক্রমণে সাফল্য অর্জনের পর পাকবাহিনী কাগজপুকুর এলাকায় পুনুরায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। তাদের মূল অবস্থান ছিল আমড়াখালী যা কাগজপুকুর থেকে ২ কিলোমিটার পূর্বে। বেনাপোলে শহরের একটি স্কুলে তাঁরা একটি স্ট্রং পয়েন্ট গড়ে তোলে। ত্রিমনি সামলাগাছিতে অবস্থান নেয় আর্টিলারি গান।
মে মাসের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বেনাপোল মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। তখন প্রতিদিন দলে দলে সাংবাদিক আসত কলকাতা থেকে। বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার চেকপোস্টে এলে বাংলাদেশ সরকার সদ্য গঠিত ইমিগ্রেশন বিভাগ তাদের পাসপোর্টে এন্ট্রি সিলমোহর বসিয়ে দিত। বিবিসির প্যানারোমা অনুষ্ঠানে মেজর ওসমান ও ক্যাপ্টেন হাফিজের সাক্ষাৎকার প্রচার করা হলে দেশবাসীর মাঝে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। ১৮ মে প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী মুক্ত এলাকা পরিদর্শনে আসেন। সকল পদবির সাথে মতবিনিময় করেন ও সারাদেশের অন্যান্য সেক্টরের যুদ্ধাবস্থার খোঁজখবর জানান এবং প্রথম ইস্ট বেঙ্গলকে ৭০০ সৈনিককে পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়ান রূপে গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। অতঃপর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল বেনাপোল থেকে ময়মনসিংহ জেড ফোর্সের সাথে যোগদান করে। মেজর ওসমান তার বাহিনীকে ইপিআর, মুজাহিদ, আনসার, পুলিশ ও কিছু বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈনিক দিয়ে পুনর্বিন্যাস করে সাতটি কোম্পানিকে বিভক্ত করেন এবং সাতজন অধিনায়কের নেতৃত্বে সীমান্তবর্তী সাতটি এলাকায় ঘাঁটি তৈরি করেন এবং সম্মুখযুদ্ধ পরিহার করে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ শুরু করেন।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!