যোগ্যছোলার যুদ্ধ, চট্টগ্রাম
[অংশগ্রহণকারীর বিবরণ]
সকালে রহিমুল্যা মাস্টারের বাড়িতে পাহাড়ি গ্রুপের কমান্ডার সহ পরবর্তী যাত্রা সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। এ সময় আমিন ডাক্তার নিজে এসে খবর দিল হালদা নদী পার হয়ে পাকবাহিনী মিজু ও রাজাকারসহ আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে লক্ষ করলাম উত্তরে বিলের অপর পাশে ধোঁয়া দখা যাচ্ছে। আমিন ডাক্তার পাহাড়ি দলপতিকে তাদের পোস্টে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। পাহাড়ের ঢাল ধরে ধাপ কাটা জমির উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম দিক কভার করে আমরা পজিশন নিলাম এবং প্রথম গুলি ছোড়ার পর সঙ্গীদের গুলি ছুঁড়তে পরামর্শ দিলাম। আমাদের দলের যোদ্ধারা পাহাড়ের ঢালে গাছের গোড়ায় পজিশন নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকবাহিনী পাহাড় ঘেরা বিলে প্রবেশ করে হেঁটে আসছে মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে আমাদের ক্যাম্পের দিকে। মাঠের পুর্ব প্রান্তে পাহাড়ে অবস্থানরত যোদ্ধারা, পশ্চিম প্রান্তের পাহাড়ে আমাদের দল। আর নিচে বিলে শত্রুপক্ষ পাকবাহিনী ক্রমশ এগিয়ে আসছে। এলএমজির রেঞ্জে আসার আগেই পাহাড়ি গ্রুপ এলএমজির ফায়ার ওপেন করে দিল। সাথে সাথে পাক বাহিনী ধাপ কাটা মাঠে আইলের পাশে পজিশনে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করল। উভই পক্ষের মধ্যে ফায়ার চলতে থাকল। পাক সৈন্যরা রকেট লাঞ্চার, কামান, এলএমজি ও রাইফেলের গ্রেনেড ব্যবহার করছে। আমরা ফায়ার ওপেন না করে পরিস্থিতি অবলোকন করছিলাম। পাক সৈন্যদের অবস্থান আমাদের এলএমজির রেঞ্জে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। পাক সৈন্যরা ক্রমশ পশ্চিমে মোড় নিয়ে আমাদের অবস্থানের দিকে পাহাড়ে পজিশন নেওয়ার জন্য ফায়ার করতে করতে হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। তারা এক একটা আইল টপকিয়ে উপরের দিকে আসতে আসতে এক পর্যায়ে আমাদের রেঞ্জের মধ্যে প্রবেশ করল। আমরা উপরে তারা নিচে। তবে তারা উঁচু আইলের অবস্থান নিয়ে এগুচ্ছে। আমাদের সহযোগী জোদ্ধা যারা ইতিপূর্বে মোটেই যুদ্ধ করেননি তাদের মনোবল অটুট লক্ষ করলাম। বেশ কিছু সংখ্যক শত্রু রেঞ্জে পৌঁছার পর ফায়ার ওপেন করা হলো। চোখের নিমিষে ৭/৮ জন পাকসৈন্য আহত হয়ে পড়ে গেল। এবং উঁচু আইলের প্রটেকশন নিয়ে একদল আমাদের দিকে অঝোরে গুলি চালাতে শুরু করল।আমরা সঞ্জতভাবে গুলি চালাচ্ছিল্লাম। শত্রু পক্ষের আধুনিক ও ভারী অস্ত্রের আক্রমনে আমাদের পজিশনের গাছের পাতা, ডাল ভেঙ্গে আমাদের গায়ে পড়ছে। অসংখ্য গাছ তাদের গুলি থেকে আমাদের রক্ষা করছে। এ যুদ্ধকালে মাস্তারপাড়ার নারি-পুরুষ আমাদের পজিশনের পেছনে দৌড়াদৌড়ি করছে। আর চিৎকার করে বলছে ভয় নেই গুলি চালান, আমরা আছি। শত্রুরা ঐদিক যাচ্ছে বা এদিকে আসছে আহতেদের দোলনায় স্ট্রেচার করে নিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। এ সকল গ্রামবাসীকে হামাগুড়ি দিয়ে চলার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও তারা ছুটাছুটি করছে। প্রায় ২ ঘণ্টা যাবৎ যুদ্ধ চলল। পাক বাহিনী ক্রমশ উত্তর পশ্চিম দিকে সরে পড়ল। অপরিচিত জায়গায় সীমিত গোলা বারুদের কারণে তাদেরকে পিছু ধাওয়া করা যুক্তিযুক্ত মনে করলাম না। পাকসেনাদের ফেলে যাওয়া কিছু তিন ইঞ্চি মটার (কামান) কিছু গোলা এবং ছয় প্যাকেট গ্রেনেড আমাদের হস্তগত হলো। যুদ্ধশেষে আমরা আবার আশ্রয়ে ফিরে গেলাম। তখন দুপুর প্রায় ১টা। কি আশ্চর্য! গৃহকর্তারা আমাদের অপেক্ষায়। বাংলা স্বাধীনতা যুদ্ধে সাধারন নারী- পুরুষের আ সমন্বয়, সহযোগিতা ও অবদান অন্তত আমি জীবনে ভুলতে পারব না। দুপুরে আহারে বসলাম। স্থানীয় গ্রামবাসীরা অনেকে জমা হলো আ যুদ্ধে জয়ের আনন্দ- উল্লাস ব্যক্ত করা জন্য। পাক আর্মিদের দুর্বলতা প্রত্যক্ষ করে সকলের মুখে একই প্রত্যয় আমাদের দেশ অচিরেই শত্রুমুক্ত হবে। তাদের পক্ষে যুদ্ধে টিকে থাকা আর মোটেই সম্বভ নয়। সারাদেশে গ্রাম গেরিলাযোদ্ধাদের দখলে। এক লোক দৌড়ে হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে জানালো পাকসৈন্যরা ফটিকছড়ি থানার দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু এখানকার যুদ্ধের কথা শুনে এবং পাকসৈন্যদের গতি লক্ষ্য করে স্থানীয় লোকেরা একটি কাঠের পুল ভেঙ্গে দিয়েছে। ফলে যে পথে এসেছে সে পথেই ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমিন ডাক্তার থেকে জানতে চাইলাম এ অতি উৎসাহী লোকটি কে? আমিন ডাক্তার জানালেন তিনি মাষ্টার পাড়ার অধিবাসী। লোকটি নিজেই বললেন, ‘ স্যার আপনারা যখন যুদ্ধ করছিলেন, তখন আমি আপনাদের পিছু নিলাম। কারণ তারা গতি পরিবর্তন করে অন্যদিকে ঘুরে আসতে পারে। পাকহানাদার, রাজাকার ও গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের চলাফেরা, আক্রমণ ইত্যাদি দেখে দেখে ক্রমশ বাংলার প্রায় সকল মানুষেই যুদ্ধ কৌশল আয়ত্ব করে নিয়েছিল।
[৮৭] মোঃ সালেহ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত