You dont have javascript enabled! Please enable it!

মেহেরপুর যুদ্ধ-১

৭ জুলাই তারিহে মেহেরপুর জেলার বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হাবিলদার শামসুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা কামদেবপুরে টহলরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করে। এ দলে ছিল জমিরউড্ডীন, শাহ আলম, সাদেক হোসেন, আবুল হোসেন প্রমুখ ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা। আকস্মিক এই আক্রমণে একজন পাকসেনা নিহত এবং ২ জন আহত হয়। এ দিন হাবিলদার মতিন পাটয়ারীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা কুতুবপুরের ১২৫ গজ দূরের প্রাচীন মন্দিরে (মঠ) আশ্রয় নিয়ে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালায়। এ দলের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শামসুল, তৈয়ব, সোনা, রায়হান, রশিদ, রহমান, আল আমিনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অবস্থানগত সুবিধার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং একজন নিহত হলে তার লাশ কাঁধে নিয়ে অন্যেরা সরে পড়ে। শিকারপুর এ্যাকশন ক্যাম্প থেকে এই একই দিনে হাবিলদার আজগর আলীর নেতৃত্বে নায়েক আব্দুল লতিফ, নায়েক হাতেম আলী, নায়েক আজিজুল হক, নায়েক মুছা, ইজাজুল হক, আব্দুল লতিফ, নায়েক হাতেম আলী, নায়েক আজিজুল হক, নায়েক মুছা, ইজাজুল হক, আব্দুল করিম, আব্দুল বারি, বরকতুল্লাহ, সানাউল্লাহ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা সাহেবনগর পাকসৈন্য অবস্থানের ওপর প্রবল আক্রমণ চালায়। এক ঘন্টা ধ্রে দু’পক্ষের গুলিবর্ষণ চলে। অবশেষে ৫০০০ গজ টেলিফোনের তার কেটে নিয়ে যায় এবং যাবার সময় পার্শ্ববর্তী দৌলতপুর থানার তোকলা ঘাটের ২টি ফেরি নৌকা ধ্বংস করে দেয়।
৮ জুলাই ইচাখালি বিওপি থেকে পাকসেনারা হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষন করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নেবার আগেই পাকসেনার গুলিতে মদনাডাঙ্গার নাসিরউদ্দিন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সময়ে গ্রামে গ্রামে গণবাহিনী বা গেরিলাযোদ্ধারা তৎপরতা এমন বৃদ্ধি পায় যে, স্বাধীনতাবিরোধী দালালরা দিনের বেলায় অত্যন্ত সাবধানে চলাফেরা করতো এবং রাতেও নিজবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র লুকিয়ে থাকতো। ৯ জুলাই একদল মুক্তিযোদ্ধা কোমরপুরের মুসলিম লীগার আফসার উদ্দীন বিশ্বাস এবং ১০ জুলাই আশরাফপুরের স্বাধীনতাবিরোধী পীর সাহেবের বাড়িতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা সত্ত্বেও তারা ঠিকই বেঁচে যায়। আদৌ তারা সে সময় তাদের নির্দিষ্ট ঘরে ছিল না। এদিন গেরিলাযোদ্ধারা মেহেরপুর থানার মধ্যেও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। থানাভবনে একটি দেয়াল সামান্য ক্ষতিগ্রস্থ হলেও কোনো মানুষের কোনো প্রকার ক্ষতি হয়নি। ১১ জুলাই পাকসেনারা কামদেবপুর এবং কালাচাঁদপুর মুক্তিবাহিনী টহল দলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও সমুচিত জবাব দেয়। এক ঘণ্টা পর গোলাগুলি থেমে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা গোভীপুরের নিকটস্থ পাক বাঙ্কারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর প্রায় প্রতিদিনই কামদেবপুর-ইচাখালি এলাকায় টহলরত পাকসেনাদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালায়। এই প্রবল গোলাগুলি মধ্যে ও অঞ্চলে অসামরিক লোকজন ছিল না বললেই চলে। তবু তাদের ঘরবাড়ি ছিল। কিছু মানুষ সাহসে বুক বেঁধে থাকতো নিজ বাড়িতে। ১২ জুলাই পাকসেনারা অসামরিক জনসাধারণের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে প্রতিরোধ গ্রহণ করে। এ অঞ্চলে যুদ্ধপরিস্থিতির বিবরণ দিতে গিয়ে ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ১৫ জুলাই ৭১ সংখ্যায় লেখা হয়ঃ….
মেহেরপুর অঞ্চলেও পাকসৈন্যদের চরম বিপর্যয় আক্রমণে অন্তত ৫৬ জন পাকসৈন্য নিহত হয়েছে। আজ এখানে সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া সংবাদে জানা গেছে, ব্যাপকভাবে মর্টার ও মেশিনগানের আক্রমণে পাকবাহিনীর সৈন্যরা নিহত হয়। মেহেরপুর শহরের ২০ মাইলের মধ্যে মহিষকুণ্ডি, প্রাগপুর, কাথুলি, গোপালপুর, শৈবনগর, ইছাখালি, কামদেবপুর, কোলা, নাটুদা, দর্শনা, শ্যামপুরে মুক্তিফৌজের গেরিলারা পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। ১২ জুলাই তারিখে মেহেরপুরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জে একদল মুক্তিযোদ্ধা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এই দিনই হাবিলদার গাজী রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা সাহেবনগরে পাকসেনা-অবস্থানের ওপর প্রবল আক্রমণ চালায়। কমপক্ষে ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়। শত্রুদের গুলিতে কাজীপুরের দু’জন সাধারণ মানুষও শহীদ হয়।
১৩ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমেদ, ম্যাজিক আব্দুল, আফসার, জমির এবং আরো কয়েকজন মেহেরপুর-নূরপুর রাস্তার মাঝে কোলার কাছে একতি মাইন স্থাপন করে। পাকবাহিনীর একটা ৩টন ট্রাক যাবার সময় মাইন বিস্ফোরণ ঘটে। কমপক্ষে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। এদিন হাবিলদার মতিন পাটোয়ারী নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করে। মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমণে পাওয়ার হাউজে অবস্থানরত পাকসেনাদের মধ্যে দুজন নিহত হয়। ৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর পাওয়ার হাউজের সমস্ত আলো নিভে যায়। ২ইঞ্চি মর্টারের গোলার আঘাতে কোর্টের কাছে একটি জিপ ধ্বংস হয়ে যায়। পাওয়ার হাউজ এবং কোর্ট এলাকা থেকে প্রবল প্রতিআক্রমণও হল। এ দিন কোলাগ্রামের তেরাস্তায় মাথায় আরও একটি মাইন বিস্ফোরিত হলে শত্রুপক্ষের ১ টনের একটি ডজগাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। এ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের সবাইকে মেহেরপুরে নিয়ে যায়। ১৪ জুলাই হাবিললদার আবু হোসেন ১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে কামদেবপুরে এবং সুবেদার মুকিতের নেতৃত্ব আরেকদল মুক্তিযোদ্ধা ইছাখালিতে পাকসেনাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ দিন ইছাখালির যুদ্ধে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। এই একই দিনে সাহেবনগরেও পাকসেনাদের অবস্থানের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল আক্রমণ করে।
[১০৩] রফিকুর রশীদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!